সাংবাদিক তুরাব হত্যার তিনমাস পেরিয়ে গেলেও এখনও আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত কাযর্ক্রম। একাধিকবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তার হাত বদলের সাথে সাথে হয়েছে তদন্ত ইউনিটেরও বদল। পুলিশের কাছ থেকে পিবিআইর কাছে দেয়া হয়েছে দায়িত্ব কিন্তু বদল হয়নি শুধু মামলার ভাগ্যের রূপরেখার।
তাই গত ১৯ অক্টোবর সাংবাদিক তুরাব হত্যাকাণ্ডের তিনমাস পেরিয়ে গেলেও এই সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করা যায়নি কাউকেই। মামলায় আসামিদের বেশিরভাগ পুলিশের সদস্য। তাই আইনের ফাঁকফোকর তাদের ভালোই জানা। এজন্য আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার ব্যাপারে যেমন বেড়েছে অনিশ্চয়তা, তেমনি বিচার প্রক্রিয়া নিয়েও পরিবারের স্বজনরা রয়েছেন দুশ্চিন্তায়।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই জুমার নামাজের পর নগরীর বন্দরবাজারে গুলিবিদ্ধ হন সাংবাদিক এটিএম তুরাব। ওইদিন পুলিশের গুলিতে তিনি মারাত্মক আহত হন। পুলিশের ছোড়া কয়েকটি বুলেট ঢুকে শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে তাকে সোবহানী ঘাট ইবনে সিনা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তুরাব।
নিহত তুরাব দৈনিক নয়া দিগন্তের জেলা প্রতিনিধি ও স্থানীয় দৈনিক জালালাবাদের স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন।
তুরাব হত্যার পর তার ভাই আবুল হাসান মো. আজরফ (জাবুর) কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটি পুলিশ জিডি হিসেবে গ্রহণ করে। এতে অনেকটা ক্ষুদ্ধ হন তুরাবের পরিবারের লোকজন। জিডি প্রসঙ্গে এসএম পির তৎকালীন উপ পুলিশ কমিশনার আজবাহার আলী শেখ জানিয়ে ছিলেন তুরাবের পরিবারের জিডি পুলিশের দায়ের করা মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তদন্ত করা হবে।
পরবর্তীতে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। গত ১৯ আগস্ট আদালতে একটি মামলা করেন তুরাবের ভাই আবুল হাসান মো. আজরফ (জাবুর)।
মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) অতিরিক্ত উপকমিশনার (ক্রাইম, উত্তর) মো. সাদেক দস্তগীর কাউছার, উপকমিশনার (উত্তর) অতিরিক্ত ডিআইজি আজবাহার আলী শেখ সহ ১৮ জনের নামে এবং ২৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহা নগর হাকিম আদালতের বিচারক আব্দুল মোমেনের আদালতে মামলাটি করা হয়। আদালত মামলাটি এফআইআর মূলে গ্রহণের আদেশ দেন।
মামলায় আরও যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন, এসএমপির কোতোয়ালি থানার সহকারী কমিশনার (এসি) মিজানুর রহমান, বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কল্লোল গোস্বামী, কোতোয়ালি থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন, পরির্দশক (তদন্ত) ফজলুর রহমান, এসআই কাজী রিপন আহমদ, মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগ সভাপতি আপ্তাবউদ্দিন, জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সহসভাপতি পীযূষকান্তি দে, সরকারি কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রুহেল আহমদ, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সজল দাস অনিক, শিবলু আহমদ, সেলিম মিয়া, আজহার, ফিরোজ ও উজ্জ্বল।
তুরাবের বড় ভাই বলেন, ‘পেশাগত দায়িত্ব পালন কালে তার ভাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার পর থানায় মামলা করা হলেও পুলিশ এটিকে মামলা হিসেবে গ্রহণ করেনি। তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালতে শরণাপন্ন হয়েছি। মামলা তিনমাস পেরিয়ে গেল কিন্তু এখনও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
ভাই হত্যার বিচার চেয়ে তিনি বলেন, ইচ্ছা ছিল আইন ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্ঠার সঙ্গে দেখা করার। বিষয়টা তাদের খুলে বলব। এসএমপি কমিশনার মো. রেজাউল করিম বলেন, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই আমরা কাজ করছি। দোষী যেই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। ৫ আগস্ট পরবর্তী পুলিশ কিছুটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। ধীরে ধীরে সবাই সক্রীয় হচ্ছে। আশা করি দ্রুত একটা পর্যায়ে পৌঁছাব।
ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক ও সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শামসুল ইসলাম জানান, ইতিমধ্যে আমাদের পক্ষ থেকে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে। রিপোর্টে বুলেটের আগাতেই তার মৃত্যু হয়েছে এটা উল্লেখ আছে।
তিনি জানান, নিহতের শরীরে ছিল ৯৮টি আঘাতের চিহ্ন। গুলিতে তার লিভার ও ফুসফুস আঘাত প্রাপ্ত হয়। মাথায় ঢিলের আঘাতও ছিল।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই-ইন্সপেক্টর মুরসালিন জানান, আমরা গত ৮ অক্টোবর মামলা তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছি। বাদী এবং স্বাক্ষী দুয়েকজনের সাথে কথা হয়েছে। তাদের অনেককে বলেছি ঘটনার মূল ভিডিওটি দেওয়ার জন্য। আমাদের কাছে যে ভিডিওটি রয়েছে তা এডিট করা এবং জোড়াতালি দেওয়া তাই ঘটনার সাথে সম্পৃক্তদের খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগছে। তাছাড়া ৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশ কার্যক্রম পুরোপুরি সক্রিয় না হওয়া টাও মামলা তদন্তে বিলম্বের একটি কারণ। এছাড়াও ঘটনার শুরুতে পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয় যেখানে ঐ মামলার বাদী সাব-ইন্সপেক্টর কল্লোল গোস্বামী বর্তমান মামলায় আসামি। বর্তমানে উভয় মামলার তদন্তই আমার দায়িত্বে রয়েছে। আমি যখনই কাউকে ডিমান্ড করবো আইনের আওতায় আনার জন্য । তখন তার বিরুদ্বে এভিডেন্স দাড় করাতে হবে। আমাদের আইনি প্রকিয়া অনুসরণ করে কাজ করতে হয়। আইনি পক্রিয়া যথাযথ অনুসরণ না করলেও সমস্যা। ঘটনার সাথে কার কি ভূমিকা তা এসেসমেন্ট করতে হয়। আমরা আমাদের সর্বাত্বক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি খুব শীঘ্রই আমরা সুখবর দিতে পারবো। তবে মামলায় যেই দোষী হোক না কেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি বলেন, যেহেতু এজাহারে আসামিদের বিস্তারিত দেওয়া আছে তাই পুলিশ চাইলে আসামিদের ব্যাপারে এতদিনে অনুমতি নেওয়ার পক্রিয়া শেষ করতে পারতো।
আইন অনুসারে সরকারি কোনো কর্মকর্তাকে গ্রেফাতারে পূর্বে প্রয়োজন তার বিরুদ্ধে অপরাধে সংশ্লিষ্ট থাকার প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করা এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশ। তার পরই মিলবে গ্রেফতারের অনুমতি। আইনের এমন ষোল কলা পূর্ণকরতেই অপরাধীদের কেউ চলে যায় নিরাপদ আশ্রয়ে। আবার কোতোয়ালী থানার সাবেক ওসি মঈন উদ্দীন শীপন আটক হয়েও ছাড়া পেয়ে যায় সহজে। তাই সাংবাদিক নেতাদের পুলিশকমিশনার অফিস ঘেরাও বা লাগাতোর আন্দোলনেও আসামিরা গ্রেফতার হচ্ছে না। এখন সবার চোখ তুরাব হত্যার নতুনভাবে দায়িত্ব পাওয়া পিবিআই কর্মকর্তাদের দিকে। তুরাবের আসামিরা কি গ্রেফতার হবে, না কি আইনের জালে বন্দি রবে গ্রেফতার প্রক্রিয়া।
এসএটি/জেডএম