নরসিংদী সদর উপজেলার আলোকবালী আব্দুল মান্নান চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী বিদেশে চলে গেলেও তার বেতন সরাচ্ছেন প্রধান শিক্ষক। তার বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাৎসহ নানান অভিযোগের ১৩ দিন পেরিয়ে গেলেও প্রশাসনিক নেই কোনো ব্যবস্থা।
এর আগে গত সোমবার (১৪ অক্টোবর) প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নরসিংদী সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে স্কুলটির সাবেক শিক্ষার্থী আহম্মেদ মিয়া লিখিত অভিযোগও করেন।
লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, রনি দাস ১০ মাস আগে বিদেশে চলে গেলেও নিয়মিত রনির বেতন উত্তেলন করা হচ্ছে। এ ছাড়াও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতাসহ বিভিন্ন অনিয়মের উল্লেখ করা হয়। অফিস সহকারী রনি দাস চাকরি ছেড়ে ১০ মাস আগে সৌদি আরবে পাড়ি জমান। তার পরও রনি দাসের বেতন উত্তোলন ছাড়াও স্কুলের নামে অনুদান আত্মসাৎ, এফডিআর আত্মসাৎ, শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানের টাকা, ফরম ফিলাপের টাকা আত্মসাৎ, আয় ব্যায়ের ক্যাশ খাতা না থাকা, কোনো প্রকার ভাউচার ছাড়াই লাগামহীনভাবে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
এ ছাড়াও তিনি প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর নরসিংদী শহরে প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে ১টি বাড়ি ও ২ টি ফ্লাট কেনাসহ রাজনৈতিক দলের পদ ব্যবহার ও বিভিন্ন দলের নেতাদের সাথে সখ্যতা দাপটকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক অনিয়ম করে যাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক দলের পদ থাকায় সবাইকে ম্যানেজ করেই তিনি বিভিন্ন অনিয়ম করে যাচ্ছেন। স্কুল কমিটির ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের পাশ কাটিয়ে একাই হয়ে উঠেছেন সর্বেসর্বা। ১৯৭২ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বর্তমানে ৮১৫ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছে।
পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, স্কুলটির অফিস সহকারী রনি দাস চাকরির ভিসায় ২০২৪ সালের ১৬ জানুয়ারি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ব্যবহার করে সৌদি আরবে পৌছেন এবং এখনও সেখানেই অবস্থান করছেন।
রনি দাসের মা বকুল রানী দাস নিশ্চিত করেছেন যে, রনি চাকরি থেকে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েই ৪ লক্ষ টাকা খরচ করে সৌদি আরবে গেছেন। তবে, আগে স্কুল থেকে টাকা পেলেও এখন তারা কোনো বেতন পান না। তবে, রনি দাস বিদেশে থাকায় তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়ে উঠে নি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তরের বেতন শীট থেকে জানা যায়, গত ৯ সেপ্টেম্বর স্কুলটির ১৯ জন শিক্ষক ও কর্মচারীকে এক বছরের জন্য ৬০ লক্ষ টাকা বেতন প্রদান করা হয়েছে। যার মধ্যে ১৬ নং তালিকায় রয়েছেন রনি দাসও।
রনি দাসের অগ্রণী ব্যাংকের ব্যাংক স্ট্যাটমেন্ট থেকে জানা যায়, প্রতি মাসে ব্যাংক হিসাবে স্কুলের বেতন জমা হচ্ছে এবং নিয়মিতভাবে ব্যাংক হিসাব থেকে এক বছরে ৫ বার টাকা সরানোও হয়েছে। সে দেশের বাহিরে অবস্থান করার পরও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তর থেকে রনির ব্যাংক একাউন্টে কিভাবে জমা হচ্ছে এবং সে টাকা উত্তেলন করা হচ্ছে, সে নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠছে।
১৯ জন শিক্ষক ও কর্মচারীর বেতনে উত্তোলন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্কুলটির সভাপতি আসমা সুলতানা নাসরিন ও অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক জয়নুল আবেদিনের স্বাক্ষর রয়েছে।
স্কুলটির শিক্ষার্থী রাজিব আহমেদ (২২) বলেন, ২০২১ সালে আমরা ১১৭ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি। যাদের প্রত্যেকের থেকে ১০ বিষয়ে ফরম পূরণ ফি বাবদ ২২০০ টাকা ফি আদায় করেছেন। করোণা সংক্রমণের কারণে ৩ বিষয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় শিক্ষাবোর্ড থেকে অন্যান্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের ৭ বিষয়ের ফি ফেরত দেয়া হলেও আমাদের টাকা প্রধান শিক্ষক আত্মসাৎ করেছেন। তিনি নানা অনিয়মের সাথে জড়িত।
স্কুলটির সাবেক শিক্ষার্থী আকরামুল ইসলাম সমীর (৪৫) বলেন, স্কুলটির প্রধান শিক্ষক জয়নাল আবেদিন ৩৮ হাজার টাকা বেতন পান। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, প্রায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনি আদিয়াবাদ এলাকায় ১টি বাড়ি ও শহরে ২টি ফ্ল্যাট কিনেছেন যা তার আয়ের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে তার বেতনের টাকা দিয়ে ৪ জন সদস্যের খরচ মিটানোর অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। সেখানে তিনি কোথায় থেকে কোটি টাকা ব্যয়ে সম্পত্তি কিনেছেন, তা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করছি।
স্কুলটির ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষক আব্দুল বাতেন আহমেদ বলেন, আমাকে বিদায় দেয়ার জন্য ৮০ জন শিক্ষার্থী থেকে ৪০০ টাকা করে ৩২ হাজার টাকা উত্তেলন করেছেন প্রধান শিক্ষক। যা তিনি নিজেই ভোগ করেছেন কিন্তু আমাকে বিদায় দিতে ৫০০ টাকাও ব্যয় করা হয়নি।
স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সদস্য শাহীন আলম বলেন, মজিদ মোল্লা ফাউন্ডেশন থেকে স্কুলকে গত দুই বছর আগে ৫ লক্ষ টাকার এফডিআর দেয়া হয়েছিল। যাতে করে এটি ব্যবহার করে ব্যাংকের লভ্যাংশ থেকে গরীব শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণ, বৃত্তি প্রদান, অতিথি শিক্ষকদের বেতন সহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করার জন্য। তাদের ফাউন্ডেশনটির শর্তানুযায়ী এফবিআর ব্যাংক থেকে উত্তেলন করা যাবে না কিন্তু নিয়ম বহির্ভূতভানে প্রধান শিক্ষক ৫ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। আমরা নির্বাচিত হয়েছি ৬ মাস অতিক্রম হলেও আমাদেরকে স্কুলের আয়-ব্যায়ের কোনো হিসাব দেয়া হয় নি। প্রধান শিক্ষক নানা অজুহাতে নানাভাবে স্কুলের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। আরেক সদস্য ফজলুল হক তার বক্তব্য সমর্থন করেন।
অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক জয়নাল আবেদিন বলেন, নিয়ম অনুযায়ী রনি দাসকে চিঠি দেয়া হয়েছে কিন্তু কর্তৃপক্ষ থেকে তার বেতন বন্ধের সিদ্ধান্ত না হলে আমি তার বেতন বন্ধ করতে পারি না। তাই রনিকে নিয়মিত বেতন দিয়েছি। আর শিক্ষককে স্কুল থেকে অবসরে না যাওয়ায় তাকে বিদায় দেয়া হয় নি। শিক্ষার্থীদের কাছে থেকে টাকাও উত্তেলন করা হয় নি। আর এসব অভিযোগ মিথ্যা। স্কুল থেকে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ মিথ্যা।
নরসিংদী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসমা সুলতানা নাসরিন বলেন, সরকারি বিধি অনুযায়ী গত মাস থেকে সকল উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। আমাদের পক্ষে সবার খোঁজ নেয়া সম্ভব নয়। একমাত্র প্রধান শিক্ষক জানেন, প্রতিষ্ঠানে কে উপস্থিত আছেন, কে অনুপস্থিত। আর আলোকবালীর স্কুলটিতে কর্মচারীর অনুপস্থিতিতে বেতন উত্তেলন করা হলে প্রধান শিক্ষক টাকা উত্তেলন করে মেরে দিচ্ছেন। স্কুলের বেতন উত্তোলন বিষয়ে স্কুলটির সভাপতি বলছেন বেতন প্রদানে প্রধান শিক্ষক নিজেই রনি দাসকে উপস্থিত দেখিয়ে বেতন উত্তোলন করছেন। কেউ উপস্থিত না থাকলে তার বেতন পাওয়ার সুযোগ নেই।
এসএটি/জেডএম