রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) পরিবহন পুলের শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহৃত একটি উপহারের বাস (রংপুর-ব-০৫- ০০১৬) হঠাৎ পরিবহন পুল থেকে গায়েব হওয়ার মতো বিরল ঘটনা ঘটেছে । বর্তমানে বাসটি কোথায় কিভাবে আছে সেটার সঠিক তথ্য কেউ বলতে পারে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের (প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরী) স্বাক্ষরে বেরোবি/রেজি/২০২৪/৮১ স্মারকে এ কে এম ছায়াদত হোসেন বকুল কে পাঠানো এক চিঠিতে বাসটি ফেরত নিতে বলা হয়। কিন্তু বেরোবি প্রশাসন বাসটি হস্তান্তর করেছ বলেও হস্তান্তরের কোন প্রকার নথিপত্র দেখাতে পারে নাই। কিন্তু পরবর্তীতে হস্তান্তরের জন্য বলা হলে বা বিভিন্ন জায়গায় নিউজ প্রকাশিত হওয়ার পরে একটা ২৪-০৫-২০২৪ তারিখের একটি স্বাক্ষর দেখিয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর বাস হস্তান্তরের চিঠি আবিস্কার করা হয়।
অভিযোগ আছে যে বাস নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় নিউজ করার পর তড়িঘরি করে পূর্বের স্বাক্ষর করা কাগজটির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে স্বাক্ষরকারী একই ব্যক্তি কি না তার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কারণ, বাস চেয়ে আবেদনপত্র আর হস্তান্তর পত্রের স্বাক্ষরের কোনো মিল নেই। এখন বাস গ্রহণ ও হস্তান্তরের স্বাক্ষরে মিল না থাকায় বিভিন্ন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে।আবার এ কে এম ছায়াদত হোসেন বকুল কে ফোন কলের মাধ্যমে অসংখ্যবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে তবে প্রতিবারে বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে বাস গায়েবের বিষয় টি ধামাচাপা দিতে এর সাথে জড়িত চক্রটি মরিয়া হয়ে ওঠেছে।
তবে অভিযোগ ওঠে কাউকে না জানিয়ে বা কোন প্রকার হস্তান্তরের চিঠি ইস্যু না করে বাসটি ক্যাম্পাস থেকে বের করা হয়েছে। কে বা কারা বের করেছে তার সঠিক উত্তর দিতে দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এমনকি পরিবহন পুলের অনেক ড্রাইভার ও হেলপাররা বলতে পারছে না কবে নিয়ে গেছে। জানতে চাইলে পরিবহনপুল ও রেজিস্ট্রার অফিস থেকে বলা হয়েছিলো বাস ফেরত দেওয়া হয়েছে কিন্তু ভুলে হস্তান্তরের কোন ডকুমেন্টস গ্রহণ করা হয় নাই।
জানা যায়, ২০১২ সালের ১২ মার্চ পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে এ কে এম ছায়াদত হোসেন বকুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যাতায়াদের জন্য ৫২ সিটের একটি বাস উপহার হিসেবে প্রদান করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মু আবদুল জলিল মিয়ার হাতে বাসটির চাবি আনুষ্ঠানিক ভাবে হস্তান্তর করেন ওয়াজেদ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ছায়াদত হোসেন বকুল। সেসময় বাস উপহার প্রদানের ছবি ও প্রেস রিলিজ জনসংযোগ দপ্তর থেকে প্রচারও করা হয়।
কিন্তু ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর ওয়াজেদ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানের পক্ষে বাসটি ফেরত চেয়ে একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছিলেন অ্যাডভোকেট রইচ উদ্দিন বাদশা। এতে বলা হয়েছিল বাসটি ৩০ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হয়েছিল এবং তিন মাসের ভাড়াও তারা পেয়েছেন। কিন্তু তৎকালীন ভিসি প্রফেসর ড. এ কে এম নূর-উন-নবী হিসাব দপ্তরে এ ধরণের কোন চুক্তি বা ভাড়া পরিশোধের প্রমাণ পাননি। বরং চাবি হস্তান্তরের ছবি ও উপহার প্রদান সংক্রান্ত সংবাদ জাতীয় ও স্থানীয় একাধিক সংবাদপত্রে প্রচারের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন।
আবারও গত ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ছায়াদত হোসেন বকুলের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে বাসটি ফেরত চাওয়া হলে সদ্য পদত্যাগকারী ভিসি প্রফেসর ড. হাসিবুর রশীদ উপহারের বাসটি ফেরত প্রদানের অনুমতি দেন এবং রেজিস্ট্রার চিঠি দিয়ে গাড়িটি ফেরত নিতে বলেন।
দুই কর্মকর্তা ও এক ড্রাইভার পারস্পরিক যোগসাজশে উপহারের গাড়িটি ফেরত প্রদান করেছেন বলে গুরুতর অভিযোগ ওঠেছে। বাসটি পরিবহন পুল থেকে নিয়ে যাওয়া হলেও সেটি এ কে এম ছায়াদত হোসেন বকুল গ্রহণ করেছেন এরকম কোন প্রমাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন দেখাতে পারেননি। বর্তমানে গাড়িটি কোথায় আছে সেটি কেউ জানে না।
বিশ্বস্ত একাধিক সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দপ্তরের এক কর্মকর্তা, পরিবহন পুলের এক কর্মকর্তা এবং এক ড্রাইভার এই ঘঠনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তারা বাস ফেরৎ বিষয়ে ছায়াদত হোসেন বকুলের মাধ্যমে উপাচার্যকে বাস ফেরত দিতে কৌশলে বাধ্য করেন এবং বাসটি বিক্রি করে নিজেদের মধ্যে টাকা ভাগাভাগি করেন বলেও লোকমুখে চাওড় রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরী বলেন, সাবেক উপাচার্য ড. ড. হাসিবুর রশীদের লিখিত অনুমতিক্রমে গাড়ি ফেরত আদেশ দেওয়া হয়। গাড়ির কে রিসিভ করছে তা পরিবহন পুল বলতে পারবেন। কিন্তু পরিবহন পুলের সাবেক পরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন আমি কি দিতে পারি? আমি গাড়ি কিনতেও পারি না দিতেও পারি না।
এ বিষয়ে পরিবহন দপ্তরের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার তাপস কুমার গ্বোসামী বলেন, আসলে বাস ফেরত দেওয়া হয়েছে কিন্তু আমাদের কাছে হস্তান্তরের কোন ডকুমেন্টস গ্রহণ করা হয় নাই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিবহন পুলের এক কর্মচারী বলেন, আমি যতদূর জানি বাসটা বকুল ভাই কে ফেরত দেওয়া হয়নি। রংপুরের কোনো এক গ্যারেজে গাড়িটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। এবং এটার প্রতিটি অংশ আলাদা আলাদা করে বিক্রি করে।
তবে কোন গ্যারেজে বিক্রি করেছে সেটা আমি জানি না। এই গাড়ি বিক্রির বিষয়টা এখানে ড্রাইভার ‘আরিফ মিডিয়া হিসেবে ছিলো।
ড্রাইভার আরিফকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমাকে বকুল ভাই গাড়িটি বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলেছিলো।আমরা গাড়িটি ৩ লক্ষ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি।এখান থেকে আমাকে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ছিলো। সেই টাকা আমাকে এখনো দেয়নি। গাড়িটি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট পার হয় তখন গাড়িটি যে কোন দিকে গেছে আমি আর খুঁজে পাইনি।
তবে তাকে কয়জন মিলে আর কার কাছে বাসটি বিক্রি করেছে বলে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, আমি এই বিষয়ে কিছুই বলব না।এতে আমার চাকরি যায় যাক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক পরিবহনপুলের কর্মকর্তা জানান, সাবেক ভিসির পিএ আবুল কালাম আজাদ বাস হস্তান্তরের এই ছিঠি জমা দিয়েছে। এই কর্মকর্তাই নানা ছলেবলে সাবেক ভিসিকে দিয়ে বাস হস্তান্তরের নামে বাসের মালিককে কিছু টাকা দিয়ে বাকি টাকা কয়েকজনে মিলে আত্মসাৎ করেছেন।
পরিবহন পুলের উপসহকারী প্রকৌশলী (অটো মোবাইল) মো. সরফরাজ আলম বলেন, বাসটি হস্তান্তর করার দায়িত্ব ছিল আমার। যেদিন ছুটিতে ছিলাম সেই দিন কে বা কারা বাস নিয়েছে আমি জানি না। এ বিষয়ে খোঁজে নিতে গেলে উপর থেকে অনেকেই চাপ দিতে থাকে। পরে এ বিষয়ে নিউজ করার পর গত ১৫ই সেপ্টেম্বর উপাচার্যের দপ্তরের পিএ টু ভিসি (সহকারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা) মো. আবুল কালাম আজাদ আমার কাছে হস্তান্তরের চিঠিটি জমা দিয়ে যায়।
মো. সরফরাজ আলম এর কথার প্রক্ষিতে ভিসির পিএ আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমি কেন হস্তান্তর চিঠি জমা দিবো? আমি জমা দেওয়ার কে? যার দায়িত্ব ছিল তারা জমা দিছে এটা তাদের ব্যপার।
আবেদনপত্র ও হস্তান্তর চিঠির স্বাক্ষরে অমিল বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কাছে জানতে চাওয়া হলে প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরী বলেন, এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।
এ বিষয়ে বাস প্রদানকারী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ ফাউন্ডেশন এর চেয়ারম্যান এ কে এম ছায়াদত হোসেন বকুল এর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও বন্ধ পাওয়া যায়।