স্কুলের বন্ধুরা মোহাম্মদ আলীর নামের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন ‘ক্লে’। না, মার্কিন কুস্তিবিদের নামের সঙ্গে মিল থাকলেও তাঁর মতো সুঠাম শরীর নেই। কুস্তি লড়ার কোনো ইতিহাস নেই কস্মিনকালেও। হ্যাংলা পাতলা চেহারার মোহাম্মদ আলী ক্লের এলাকায় পরিচিতি ভিন্ন কারণে।
মানুষের জন্ম, মৃত্যু, বিয়ের দিনক্ষণ লিখে রাখা তাঁর শখ। দেশ-বিদেশের উল্লেখযোগ্য ঘটনা, নির্বাচন, দুর্ঘটনা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও নায়ক-নায়িকাদের জন্ম-মৃত্যুর ঠিকুজিতে ভরা তাঁর ডায়েরি আর খাতা। ৩০ বছর ধরে এসবের সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন কুড়িগ্রামের ৫৬ বছর বয়সী এই কৃষক।
চমৎকার নামের সঙ্গে সবুজের মিতালি মন কেড়ে নেয়। কুড়িগ্রাম-রংপুর সড়কে ত্রিমোহনী বাজার থেকে দক্ষিণে এক কিলোমিটার যেতেই নীলকণ্ঠ গ্রাম। গাঁয়ের লোক সহজেই দেখিয়ে দিল মোহাম্মদ আলীর বাড়ি। মানুষটা আলাপি।
১৯৮৪ সালে এসএসসি পাস করেছেন। আর্থিক দৈন্যের কারণে পড়াশোনা এগোয়নি। পরে জীবিকার তাগিদে কৃষিকাজ করেছেন। একসময় রিকশা চালিয়েছেন। দিনমজুরির কাজও করতেন মাঝেমধ্যে।
এত দৈন্যের মধ্যেও গড়ে তোলেন তাঁর শখের সংগ্রহশালা। তাঁর সংগ্রহের কথা জিজ্ঞেস করতেই পুরনো আলমারি থেকে একে একে বের করে আনেন অমূল্য সংগ্রহগুলো। পুরনো, নতুন ডায়েরির সঙ্গে বড় বড় খাতা ও পত্রপত্রিকা।
৩০ বছর আগে ডায়েরি লেখা শুরু করেছিলেন। মানুষের জন্ম, মৃত্যু, বিয়ের তারিখ লিখে রাখেন ডায়েরি বা খাতায়। খ্যাতিমান ব্যক্তির মৃত্যু হলে জন্ম-মৃত্যুর তারিখের সঙ্গে থাকে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও। দেশের নির্বাচনসহ বড় বড় ঘটনার বর্ণনাও মেলে তাঁর ডায়েরিতে। চলচ্চিত্র শিল্পী ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বদের মৃত্যু নিয়ে রয়েছে আলাদা খাতা ও ডায়েরি। বেশ কিছু পুরনো পত্রপত্রিকার ক্লিপিংও আছে। সরেজমিনে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও তিনি এই কাজে সাহায্য নেন পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের।
শত শত মানুষের জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ের তারিখ মুখস্থ বলতে পারেন। এ কারণে অনেকেই তাঁকে বলে ‘জীবন্ত ডায়েরি’। প্রায় ছয় হাজার মানুষের জন্ম, মৃত্যু, বিয়েসহ অন্যান্য ঘটনার তারিখ সংরক্ষিত আছে তাঁর সংগ্রহশালায়। আশপাশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন তাঁর কাছে আসে নিকটজনের মৃত্যুর তারিখটি সংগ্রহের জন্য। তিনি উপযাচক হয়ে জন্মদিন-মৃত্যুদিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেন অনেককে।
বসতভিটা ছাড়া মোটে ২৫ শতক জমি সম্বল মোহাম্মদ আলীর। ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসল হয় না। এখন একমাত্র ছেলের আয়ে সচল সংসারের চাকা। অভাবের মধ্যেও পরিবারের সদস্যরা তাঁর এই কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন তাঁকে জুগিয়েছেন উৎসাহ আর প্রেরণা। সাবিনা বলেন, ‘অনেক বছর ধরে দেখছি শখ পূরণে তিনি কতটা শ্রম দেন। কত জায়গায় যান। ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। কিন্তু অর্থাভাবে যেতে পারেন না অনেক জায়গায়। প্রথম প্রথম বিরক্ত হলেও এখন মনে হয়, সবাই তো এমন কাজ করতে পারবে না। উনার কাজের একটা মূল্য আছে।’
মোহাম্মদ আলী জানান, তিনি সবার মতো নন, বিকল্পধারার মানুষ হতে চান। লোকে যতই টিটকারি করুক, এই কাজের সঙ্গে তাঁর ভালোবাসা ও আবেগ জড়িয়ে আছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শখের সংগ্রহশালাটি সমৃদ্ধ করে যেতে চান। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি পাঠাগার গড়ে তোলারও স্বপ্ন দেখেন। তবে সংরক্ষণের অভাবে তাঁর অমূল্য সংগ্রহগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।