আচরারুল হক আর শারমিন মুস্তারি নাজু। দুজনেই আবৃত্তির মানুষ। পরিচয়টা সামাজিক মাধ্যমে হলেও সম্পর্কে গড়িয়ে দেয় আবৃত্তি। সেখান থেকে প্রেম। তারপর? তাদের মুখ থেকেই শুনবো।
আচরারুল হক আজিম গ্রুপের ওভেন ডিভিশনের ইন্টারনাল এক্সিকিউটিভ অডিট আর নাজু বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত উপস্থাপক। দুজনেই আছেন আবৃত্তি সংগঠন ‘প্রমা’ ও ‘তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে’র সাথে। উপস্থাপনার বাইরে শারমিন মুস্তারি নাজু বিভিন্ন ইভেন্ট, ভয়েজ ওভার, ফ্রি ল্যান্সিং করেন। সরকারি চাকরির কথা মাথায় রেখে তিনি বর্তমানে একটা কনসালটেনসি সেন্টারে সিনিয়র ফ্রন্ট ডেস্ক অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এছাড়া কবি কাজী নজরুল একাডেমি, চট্টগ্রাম এর প্রি-স্কুলের কো-অর্ডিনেটর হিসেবেও কাজ করেছেন নাজু।
মজার বিষয় হলো আচরারের কথাগুলো বেশিরভাগ নাজু বলছিলেন,আর নাজুরগুলো আশরার। সম্পর্কে তারা স্বামী-স্ত্রী, পরস্পরের বন্ধু আবার রোমান্টিক যুগল।
সম্পকটা কিভাবে? দুজনের মুখেই হাসি। নাজু বললেন, ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কের শুরু ঝগড়ার মধ্যেমে। আশরারের ওয়ালে আমার আইডিটা নাকি মাছির মতো ঘুরতো। সেজন্যেই ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠালো। একসেপ্ট করলাম আমি। তখন সে নক করলো। আমার তখন মেজাজ গরম হলো। আরে! এ তো ভাব জমাতে চায়। নাজুকে থামিয়ে দিয়ে আশবার বললো, প্রতিদিন যখন এই আইডিটা আসছে, তখন একদিন সেখানে ঢুকে দেখলাম আবৃত্তি, নাটক, নাচ, সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট। প্রোফাইলে ঢুকলাম। দেখলাম আসলেই তার কাজের জায়গা বিশাল। আমি ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট দিলাম। সে একসেপ্ট করার পর আমি ধন্যবাদ জানাতে গিয়েই পড়লাম বিপদে। নাজু হেসে যোগ করলেন, ভদ্র কথা কাটাকাটি হয়েছে। আমার ভয়েস ম্যাসেজে সে বিরক্ত হলেএ কণ্ঠ শুনে নাকি ভালো লেগেছে। এরমধ্যে আবার টেলিভিশনে একত্রে আমাদের বেশকিছু প্রোগ্রামও হয়েছে। আশরারের আবার স্বতঃস্ফূর্ত মানুষ খুব পছন্দ। লকডাউনে আমি বাড়ি চলে যাই। কিন্তু ওকে না বললেও আমি গোপনে ওর প্রেমে পড়ে গেছি। কারোনায় যখন সে আক্রান্ত হলো নিয়মিত খবর নিতাম। ভয় লাগতো কী না হয়ে যায়। নিয়মিত কথাবার্তা হতে হতে একসময় আমরা বুঝলাম, আমরা দুজনেই দুজনকে ভালোবাসি। বয়সের গ্যাপ আমাদের অনেক বেশি থাকলেও মনে হলো, মিলে যাচ্ছেতো তারপরেও। এপ্রিলের ১৩ তারিখ শুরুর সময় ১.৫২ মিনিটে সে আমকে সিগনাল দেয় সে একটা সম্পর্কে যেতে চাইছে। সেদিন থেকে আমাদের প্রেম শুরু। জুনের প্রথম দিকে আশরার তার বাবাকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানায়। আমার শ্বশুর খুব পজিটিভ মানুষ। ছবি দেখার পর বাবা ফোন নম্বর চাইলেন। আমার সাথে কথা বললেন। আর এদিকে আমার মা’র সাথে আমিও ভয়ে ভয়ে কথা বললাম। মা বললেন, বয়স কোন ব্যাপার নয়, যদি তোমাদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া থাকে। আমার মা চট্টগ্রাম ছিলেন অনেক বছর। বাবা ছিলেন আর্মিতে। চট্টগ্রামের যে রীতি বা বরিশানের যে নিয়ম এগুলো কিছূই আমাদের বিয়েতে তেমন প্রভাব ফেলেনি। সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখ থেকে একসাথে পথ চলা শুরু।
ছুটির দিনগুলো কীভাবে কাটে? প্রশ্নের জবাবে নাজু বলেন, আয়োজন করে আমাদের ঘোরাঘুরি হয় না, তেমনি আয়োজন করে আমাদের ছবি তোলাও হয় না। আমি টেলিভিশন থেকে এলাম ও অফিস থেকে এলো! বললাম, চলো ছবি তুলি। ফুচকা খেতে খেতে ছবি তুলি। আচরার বলেন, আমাদের মনে হয় নির্দিষ্ট করে আলাদা কোনো জগত নেই। সবাইকে নিয়ে থাকার মধ্যে, সবার ভেতর থেকে আমরা আমাদের খুঁজে নিই। আমরা ছবি তুলতে এবং তুলে দিতে পছন্দ করি।
আচরার জানালেন, আমি প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ষোল বছর ধরে। আবৃত্তির পাশাপাশি শিশু বিভাগের একজন প্রশিক্ষক হিসেবেও আছি। চট্টগ্রাম টেলিভিশনে নিয়মিত আবৃত্তি করি ২০১১ সাল থেকে।
এখনো আমাদের মধ্যে মধ্যে প্রেম প্রেম ভাবটা রয়ে গেছে উল্লেখ করে আশরার বলেন, আমাদের পরিবার যৌথ। যেহেতু আমাদের প্রেম করে বিয়ে হয়েছেঃ তাই এখনো আমাদের মধ্যে মধ্যে প্রেম প্রেম ভাবটা গেছে। আমরা দুজনেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে জড়িত। তাই সময়টা, সময়ের কাছ থেকে আসলে চুরি করে নিতে হয় আমাদের। সময় চুরির ব্যাপারটা বেশ মজার। একজনের প্রোগ্রাম থাকলে অন্যজন যদি ফ্রি থাকে তখন দর্শক গ্যালারিতে বসে যান নাজু কিংবা আশরার। ভালো কোনো সিনেমা আসলে দুজন একসাথে চলে যান সিনেমা দেখতে।
নাজু আরেকটু যুক্ত করলেন,এখানে আমাদের দুজনের খুব মিল। জীবনে ব্যস্ততা, টেনশন, পারিবারিক কাজ সবই থাকবে। এর মধ্য থেকে আমরা আমাদের সময়টা বের করে নিই। আমরা খুব হাসি, প্রচেষ্টা থাকে মানুষের মুখেও হাসি ছড়িয়ে দেয়া।
নিজের সম্পর্কে নাজু জানালেন,আমার কালচারাল জার্নি শুরু হয় চার বছর বয়স থেকে। মায়ের উৎসাহ ছিলো। ক্লাসের পড়া শে দ্বারা চাইতেন পড়াশোনা মনোযোগী থাকি বেশি। তাই ক্লাসের পড়া শেষ করে আবৃত্তির চর্চা করতাম, ক্লাসে যেতাম। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য স্মৃতি, ক্লাস ফাইভে আমি আবৃত্তি এবং উপস্থিত বুদ্ধিতায় জাতীয় শিশু পুরস্কার, ২০০৬ পাই। প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে আমি পুরস্কার গ্রহণ করি। উপস্থিত বক্তৃতায় তৃতীয় এবং আবৃত্তিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করার জন্য আমাকে এ পুরস্কার দেয়া হয়। ২০০৭ এ জাতীয় পুর নাট্যউৎসব বরিশাল থেকে আটজন সিলেক্টেড ক্ষুদে আবৃত্তি শিল্পীদের ঢাকা একটা টিম যায়। ওখানে আমি আবৃত্তি করি। ২০০৭ এ আমি বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ডিভিশনে প্রথম হই। একই বছরে সারা বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আয়োজিত শিশু প্রতিযোগিতা হয়। ছোটবেলায় আবৃত্তি ছাড়াও নাচ, গল্পবলা, অভিনয় করতাম। পড়াশোনার রেজাল্টও খুব ভালো ছিলো। সে কারণে পারিবারিক বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়নি। আমার বেড়ে ওঠা মফস্বলে। মা’র সাপোর্ট ছিলো অনেক বেশি। আমি মনে করি এটি আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অঙ্গনে যুক্ত হই। ওখানে আমিই একমাত্র বাইরের শিল্পী হিসেবে উপস্থাপনা করতাম। ড.কুন্তল বড়ুয়া স্যার সেখানে আমাকে খুব সাহায্য করেছিলেন সেসময়। কম্পিউটার সাইন্সের ছাত্রী হয়েও এসবে যুক্ত হওয়া অনেক চ্যালেজিং, তবু্ও অঙ্গনে যুক্ত হয়ে গেলাম। অঙ্গন আমাকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। এরপর তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের সাথে যুক্ত হই। টেলিভিশনে আবৃত্তি করি অনেক আগে থেকে। আর জীবনের সবচয়ে প্রাপ্তি আশরারের মতো জীবনসঙ্গী পাওয়া এখনো যে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে থাকতে পারছি সেটা তার সাপোর্ট থাকার কারণে।
আচরার বলেন, আমি ওর এই গুণ দেখেই বিয়ে ররেছি। আমি যখন ওর সেই কাজে সাপোর্ট হবো তখন তো সে আরো সফল হবে। এটাও আমাদের পক্ষ থেকে একটা ম্যাসেজ যে, আমি মানে আমাদের চারপাশের সবকিছূ নিয়েই আমি। জীবনের নির্যাস বলতে আমি বুঝি একজন অন্যজনের পাশে থাকা। ইতিবাচক চিন্তায় বিশ্বাসী আমি। জীবনে অনেককিছুই থাকবে না, তবুও নিজেকে মনে হবে সুখী। সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত যারা আছেন সেসব দম্পতির জন্য আমরা বলবো, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস এবং সহযোগিতা থাকা জরুরি। এই জায়গায় একজন আরেকজনের কাজের জায়গাকে সম্মানের চোখে দেখবে।
কথার পিঠে কথা। কতক্ষণ যে এভাবে কেটে গেছে এক বসায় তার হিসেবে নেই! থাকবেই বা কিভাবে? সাহিত্য সংস্কৃতির মানুষের গল্পগুলো তো কেবল শুনতেই ভালো লাগে। সেই ভালো লাগায় ইতি টানতে নাজু আবৃত্তি করতে লাগলেন কবিতা।
কবিতা আমার প্রজাপতি
রং বেরঙের পাখা
কবিতা আমার ওড়ে শুধু যায় না ধরে রাখা
কবিতা আমার ভেসে বেড়ছে। মেঘের ভেলা হয়ে চড়ে
কবিতা আমার বৃষ্টি হয়ে টিনের চালে পড়ে। কবিতা আমার দুচোখ জুড়ে আলো ছায়ার খেলা কবিতা আমার নিতুই রাতে
জোনাক বাতির মেলা
কবিতা আমার দীঘির ঝিলে শাপলা ফোটা জেলার দোর কবিতা আমার সাঁঝ বেলাতে আগুন লাগা চোরা ভোর কবিতা আমার চলার পথে সঙ্গী হয়ে থাকে কবিতা আমার হৃদয় বঙিন ছবি আঁকে।