একদিন সন্ধ্যায় পূর্তুলিকার টবে একটা ঘুঘুকে বসে থাকতে দেখে কাছে এগিয়ে গেলাম। সে যাচ্ছে না, ভয়ও পাচ্ছে না। চুপচাপ বসে থাকা দেখে মনে হলো কোথাও কোনো শিকারীর তাড়া খেয়ে হয়তো এসেছে। এভাবে কিছু সময় পার হবার পর উল্টো ভয় পেতে শুরু করলাম। ও আসলেই পাখি নাকি পাখির রূপ ধরে অন্য কিছু! মেয়ে বারবার ওকে বিরক্ত করছে। পাখির সঙ্গেই যেন সে নির্ঘুম রাত কাটাতে চায়। মেয়ের খুশি দেখে বললাম পাখিটি এখানে বিশ্রামের জন্য এসেছে বিরক্ত করলে ও চলে যাবে।
এভাবে দুইদিন পেরিয়ে গেল। এরপর দেখি ওর সঙ্গীও আসতে শুরু করেছে। দুটো ডিম পেড়েছে। তাও আবার ঘরের বারান্দার টবে! ইট পাথরের নগর জীবনে এ যেন কল্পনার মতো। বারান্দাটি আমার একচিলতে ভালোবাসার বাগান। বাগানে রয়েছে রঙ্গন ও কামিনী ফুলের গাছ। যেগুলো বাগানের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণ। রঙ্গনের লাল ফুলগুলো যেমন বাগানকে জীবন্ত করে তোলে তেমনি কামিনীর সাদা ফুলের মনোরম ঘ্রাণ পুরো বারান্দায় ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া আছে কাঁটা মুকুট, রেইন, লিলি,বাগান বিলাশ, চায়না বট, সাদা চেরি, লাল চেরি, অপরাজিতা, রজনীগন্ধা, পূর্তুলিকা, মল্লিকা,মিরর বুশ, স্ন্যাকস প্ল্যান্ট, অর্কিড, প্লাম আরালিয়া,পানদান, মানি প্যান্ট, এলোভেরা,লাকি বেম্বো, বস্টন ফার্ন এবং পুদিনা গাছও।
এবার পালা করে দুজন তা দিতে শুরু করে। মেয়ে ঘুঘুটি খাবারের সময় হলে মিষ্টি করে ডাকলেই সঙ্গীটি এসে ডিমে তা দেয়। মেয়ে পাখিটি ফিরে আসলে পুরুষ ঘুঘুটি চলে যায়। নবাগত ছানার আশায় ওদের চোখে মুখে যেন আনন্দের ঢেউ ছুটছে। কিছুদিনের মধ্যেই ফুটফুটে দুটো ছানার জন্ম হয়। মা পাখি ছানাদের খাবার আনতে যায় তখন পাশে থাকে বাবা। খাবার নিয়ে আসলে ছানাদের কিচিরমিচির শব্দ বাড়ে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনতে কার না ভালো লাগে? তবে নগর জীবনে এ ভাগ্য ক’জনেরই বা হয়।।
সকালের ঘুম ঘুম চোখে ঘুঘুর ডাক গ্রামের একটা অনুভূতি এনেদেয়। ব্যস্ততার শেষে ক্লান্তি এসে যখন একটু প্রশান্তির জন্য বিদ্রোহ শুরু করে তখন এ বারান্দার প্রাকৃতিক পরিবেশ সব ক্লান্তি অবসাদ এক নিমিষেই দুর করে দেয়। ব্যস্ততার মাঝেও পাখিদের সাথে,গাছের সাথে কথা বলে কিছুটা সময় পার হয়। পরস্পর এক অন্যরকম অনুভূতি শেয়ার হয়। প্রাণীদের প্রতি অদ্ভুদ রকমের ভালোবাসা থাকায় সবসময় পাখি, খরগোশ, বিড়াল এগুলোকে পোষ মানিয়ে পালতাম।
আমার বারান্দায় বাহিরের পাখিদের জন্য আলাদাভাবে কিছু খাবার ও পানি রেখে দেই সবসময়। বিশ্রামের জন্য আলাদা মাটির হাড়ি,বাবুইর বাসা এনেও ঝুলিয়ে রেখেছি। নানান রকমের পাখিরা আসে,বিশ্রাম নেয় আবার চলে যায়। কখনও কাছে গিয়ে ধরতে চাইলে চট করে উড়ে চলে যায়।
জীবন মানেই সুখ দুঃখের একটা বেলাভূমি। কখনও সুখ মেঘের ভেলা কখনও দুঃখ মেঘের ঘনঘটা ঘিরে ধরে। এতো খুশির মাঝেও সবার মত এই ঘুঘু দম্পতির ক্ষণিকের জীবনেও নেমে এসেছে দুঃখের ক্ষণ। ভয়ে আতঙ্কে একরাত এই দম্পতি তাদের প্রাণপ্রিয় ছানাদের কাছে আসেনি। ভয় কাটানোর জন্য ঘরের সব লাইট বন্ধ করে দিলাম যাতে ওরা আরো বেশি নিরাপদ বোধ করে। কিন্তু বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো, রাত বাড়তে শুরু করলো ওদের আর ফেরার নাম নেই। ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। কি করবো? আমাকে বিশ্বাস করে ওরা যে ভালোবাসার নীড় বেঁধেছে।
আমার একটুকরো বাগানকে, আমাকে নিরাপদ ভেবে সন্তানের জন্ম দিয়েছে। তাদের সেই সদ্য জন্ম দেয় ছানাগুলোকে আমার কাছে আমানত রেখে গিয়েছে। ওরা মায়ের উষ্ণতা আর ক্ষুধায় ছটফট করছে। আল্লাহর উপর ভরসা করে বেরিয়ে পড়লাম ওদের খাবারের খোঁজে। অনেক চেষ্টার পর ওদের খাবার নিয়ে ফিরে এলাম। এক ঘন্টা পরপর ফিড করাতে থাকি আর দোয়া করতে থাকি।
চারদিকে রাতের আঁধার কেটে সকালের আলো ফুটেছে। তখনই দেখি অনেক উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তার মাঝে ছানাদের বাবা,মা দুজনই ফিরে এসেছে। ছানাগুলোকে মায়ের উষ্ণতায় দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। ওরা আবারো ভয়হীন সুখে শান্তিতে ছানাদের নিয়ে বসবাস করছে।