সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে থাকা নীল অপরাজিতা মনে স্নিগ্ধতার আবেশ জাগায়। মনে হয় সবুজ ডাঁটায় নীল প্রজাপতি এসে বসে আছে। অপরাজিতা ফুল নীল ছাড়াও সাদা, হালকা বেগুনি, হলুদ ও লাল রঙেরও হয়ে থাকে। এটি ফ্যাবেসি পরিবারের একটি ফুল। অপরাজিতা ফুলটির আগমন ঘটে মালাক্কা দ্বীপ থেকে। মালাক্কা দ্বীপ বা ternat থেকে এসেছে বিধায় এই অপরাজিতা ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Clitoria ternatea, এটি Fabaceae পরিবারের Papilionacae উপপরিবারের আরোহী, লতানো উদ্ভিদ। Clitoria -এর বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় যোনিপুষ্প। আকৃতির জন্য এ ফুলকে যোনিপুষ্প বলেও ডাকা হয়। ভারতের কেরালায় অপরাজিতা ফুলের নাম শঙ্খপুষ্পী।
ইংরেজিতে এই ফুল এশিয়ান পিজিয়ন উইংস, ব্লুবেল ভাইন, ব্লু পি , বাটারফ্লাই পি, কর্ডোফোন পি এবং ডারউইন পি নামে পরিচিত। নীল অপরাজিতা গাঢ় নীল রঙের কিন্তু নিচের দিকটা এবং ভেতরটা সাদা, কখনো বা একটু হলদে আভাযুক্ত হয়। প্রকৃতিতে দুর্লভ প্রজাতির দ্বৈত পাপড়ির অপরাজিতা ফুলও দেখতে পাওয়া যায়। ফুল দেখলে মনে হয় গাছের গায়ে প্রজাপতি বসে আছে। এ জন্য এই ফুলকে প্রজাপতিসম পুষ্প বলা হয়।
শরীরের জন্য উপকারী অপরাজিতা ফুলের চা- কথাটি শোনার পর অবাক হবেন হয়তো অনেকে। মূলত অপরাজিতার চা সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই। নীল চা বা ব্লু টি নামে পরিচিত এ ফুলের চা। এটি সম্পূর্ণ ক্যাফেইনমুক্ত হারবাল চা। নীল অপরাজিতার নীল চায়ে থাকা পলিফেনল ও ফ্ল্যাভোনোয়েড যৌগ লিভার এনজাইমের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। ফলে লিভারের সুরক্ষায় অসাধারণ ভূমিকা পালন করে নীল অপরাজিতা ফুলের চা। চঞ্চলতা ও হতাশা কাটানোর এক দারুণ ওষুধ এই নীল-চা। যে ফুল থেকে এই উপকারী চা তৈরি করা যায় সেই ফুলটির সঙ্গেই আজ পরিচয় করিয়ে দেব। নীল অপরাজিতা ফুলের ছবিটি সম্প্রতি মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বাগান থেকে তুলেছি।
অপরাজিতা ফুলের গাছটি লতানো এবং সবুজ পাতাবিশিষ্ট। পাতার গঠন উপবৃত্তাকার। পূর্ণাঙ্গ একটি ফুলগাছ ঝোপের মতো হয়ে যায় এবং প্রায় সারা বছর ফুল ফোটে। দীর্ঘজীবী এ গাছটি প্রায় ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ঔষধি গুণবিশিষ্ট এ ফুলটি ছাদবাগান বা স্বাভাবিক বাগানে নানা বাহারি ফুল মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি করে। সুন্দর রং ও গঠনে নজর কাড়ে এই অপরাজিতা ফুল।
অপরাজিতা ফুলের উপকারিতা যেমন রয়েছে, তেমনি এর বয়স কম হলেও ৫ কোটি বছর। সারা বছরই নীল অপরাজিতা ফুল ফোটে। নীল অপরাজিতার শাখা-প্রশাখা অল্প সময়ে ছড়ায়। সে তুলনায় সাদা অপরাজিতার শাখা-প্রশাখা ছড়াতে দেরি হয়। অপরাজিতা শুধু সৌন্দর্যে সীমাবদ্ধ নয়, এ ফুল ঔষধি গুণেও ভরপুর ও অতুলনীয়। অপরাজিতা ফুল, এর পাপড়ি, মূল ও গাছের লতা বিভিন্ন রকম ভেষজ চিকিৎসায় বহুকাল থেকে ব্যবহৃত হচ্ছে। অপরাজিতা ফুল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র হিসেবে পরিচিত। তা ছাড়া শারদীয় দুর্গোৎসবে ষষ্ঠীতে এবং বিজয়া দশমীর পূজায় এ অপরাজিতার ব্যবহার দেখা যায়।
এ ফুলে অধিকমাত্রায় ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস রয়েছে। যার ফলে এর ঔষধি গুণাবলিও অনেক। অপরাজিতা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। যার ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। অপরাজিতায় বিদ্যমান স্যাপোনিন ও ফ্ল্যাভোনোয়েড যৌগ অ্যাজমা প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অপরাজিতায় রয়েছে অ্যান্থোসায়ানিন, যা মানবদেহে ফ্রি রেডিক্যাল তৈরিতে বাধা দেয় এবং ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটি স্মৃতিশক্তিবর্ধক। তাই আলঝেইমার রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, এটি রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইডস, কোলেস্টেরল ও এলডিএল কমানোর মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে থাকে।
লেখক: অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রকৃতি বিষয়ক লেখক