মহাশিং নদীর কোল ঘেঁষে রাজকীয় মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে এই নিদর্শনটি। যার সম্পর্কে না জানলে কেউ এটাকে সম্রাট আকবরের রাজপ্রাসাদ বা সম্রাট শাহ্জাহানের প্রিয়তমা মমতাজের প্রতি ভালোবাসার স্মৃতীর সেই তাজমহল ভাবতেই পারে। এতে ভুলের কিছু নেই। কারণ তাজমহল নির্মাণে যে-সব পাথর ব্যবহার হয়েছিল এই নিদর্শনটিতেও একই রকম পাথর ব্যবহার করা হয়েছে।
সেজন্য দৃষ্টিনন্দন এই প্রাচীন নিদর্শন সৌন্দর্যের এই খেতাব অর্জন করে নেয় অনায়াসে। প্রথম দেখায় যে কেউ এর প্রেমে পড়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবেন। তাই তো দিন দিন এটিকে একনজর দেখতে মানুষের ভিড় জমে চোখে পড়ার মতো। এখন নিশ্চয় এর নির্মাণ, অবস্থান ও সৌন্দর্য জানার আগ্রহ জন্মেছে, তাহলে জেনে নিন।
শত বছরের পুরোনো স্থাপত্য নিদর্শন সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম পাগলার রায়পুর গ্রামে অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে এটি বড় মসজিদ নামে পরিচিত। মহাশিং নদীর কোল ঘেঁষে রাজকীয় মহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা যে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করা ঐতিহাসিক এ মসজিদটি নির্মাণের পিছনে রয়েছে নানান ঘটনা। সেটা না হয় শেষে বলবো। তার আগে জেনে নেই মসজিদের মনকাড়া সৌন্দর্য।
দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকলা ও প্রবাহমান মহাশিং-এর এক কূলে দাঁড়িয়ে যেন সভ্যতার ক্রমবিকাশ পর্যবেক্ষণ করছে এই মসজিদ। মসজিদের সামনে বিশাল ঈদগাহ ময়দান ও উত্তরপার্শ্বের গেট দিয়ে প্রবেশ করে সামনেই দেখবেন মহাশিং নদী। ডান দিকে তাকালেই সেখানে আপনার নজর আটকে যাবে। কারণ সেখানে রয়েছে আপনার আসার উদ্দেশ্য’র কাঙ্ক্ষিত সেই নিদর্শন। আর ঠিক তখনই আপনি এই মসজিদের ভিতরের রূপ দেখার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে যাবেন।
ভিতরে প্রবেশ করা মাত্রই ফ্লোর ও তার আশপাশের কারুকার্য দেখলে রীতিমতো তাজমহল ভেবে নিবেন। তবে নামাজের জন্য নির্ধারিত মূল স্থান দোতলায় থাকলেও মসজিদের মিহরাব অংশে জমকালো পাথর কেটে আকর্ষণীয় ডিজাইন তোলা হয়েছে। পুরো মসজিদের চারপাশে তিনফুট উচ্চতা পর্যন্ত যে কারুকার্য খচিত টাইলস লাগানো হয়েছে, সেটাও উঁচুমানের স্থাপত্যশৈলীর ইঙ্গিত দেয়।
টাইলসগুলো আনা হয়েছিল ইতালি, জার্মানি ও ইংল্যান্ড থেকে। প্রত্যেকটা প্রবেশদ্বারে পাথরখচিত খিলান মসজিদটিকে বেশ দৃষ্টিনন্দন করে তোলে। মসজিদের নিচতলার ছাদ ঢালাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে রেলের স্লিপার। ছাদ ও গম্বুজের চারপাশে পাথর খোদাই করা পাতার ডিজাইন গ্রামীণ ঐতিহ্যের জানান দেয়। মসজিদের দোতলার মেঝেতে রয়েছে দুর্লভ শ্বেতপাথর, তার চারপাশে ব্লকে দেয়া ব্ল্যাক স্টোন বা কালোপাথর তো আরও বেশি দুর্লভ। এগুলো আনা হয়েছে ভারতের জয়পুর থেকে। তখনকার অবিভক্ত ভারতের সাথে নদীপথের যোগাযোগই সহজ ছিল। মসজিদে ব্যবহৃত এই জাতের পাথর একমাত্র তাজমহলে ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানা যায়।
মসজিদটি নদীর কূল ঘেঁষে নির্মিত হওয়ায় ডেকার হাওরের পূবালী বাতাস সবসময়ই মসজিদের ভিতর প্রবেশ করে। মুসল্লিরা সবসময়ই একটা তাপমাত্রাবান্ধব অনুভূতি পান নামাজের সময়। যেন স্বর্গীয় একটা অনুভূতি অনুভব করা যায়। তাছাড়া আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে দ্বি-তলা বিশিষ্ট এই স্থাপনাটিতে কোনো ধরনের রডের ব্যবহার ছাড়াই সম্পূর্ণ ইটের উপর নির্মাণ করা হয়েছে।
মসজিদটি ৬৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও বারান্দাসহ ২৫ ফুট প্রস্থের গম্বুজসহ মোট উচ্চতা ৪০ ফুট ও ছয়টি স্তম্ভের উপর ছয়টি মিনার, তিনটি বিশাল গম্বুজ এবং ছোট সাইজের আরও ১২টি মিনার রয়েছে। মসজিদের ভূমিকম্প নিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে ভূমি খনন করে বেশ মজবুত পাতের উপর স্থাপনাটির ভিত নির্মিত। ফলে অনেকগুলো বড় মাপের ভূমিকম্পও এখন পর্যন্ত মসজিদটিতে ফাটল ধরাতে পারেনি।
মসজিদ নির্মাণের পর এখনও বড় ধরনের কোনো সংস্কারের প্রয়োজন পড়েনি। অবশ্য কেবল গম্বুজের এক জায়গায় খানিকটা লিকেজ দেখা দিয়েছিল আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে। তখন গম্বুজের উপরের দিকের কিছু পাথর পরিবর্তন করতে হয়েছিল। বিশেষজ্ঞ স্থপতিদের তত্ত্বাবধানে বেশ সতর্কতার সাথে সংস্কার কাজ সম্পাদন করা হয়েছে, যাতে মূল গঠনে কোনরূপ পরিবর্তন না ঘটে।
এখন আসি মসজিদের নির্মাণ সালের কথা ও রহস্যে। ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ৫ই আশ্বিন শুক্রবার এই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় রহস্যময়ী এই মসজিদের। মসজিদের মূল প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসিন মির্জা ও তার ভাই ইউসুফ মির্জা মিলে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। নির্মাণকাজে মূল মিস্ত্রিসহ জোগালিরা ছিলেন ভারতীয় ও মূল স্থপতির নাম মুমিন আস্তাগার। যার পূর্বপুরুষ ভারতের তাজমহলে কাজ করেছেন বলে জানা যায়। এতে প্রায় দশ বছর যাবত নির্মাণকাজ চলে।
মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসিন মির্জা ও তার ভাই ইউসুফ মির্জা বেশ বিত্তবান এবং ধর্মপরায়ণ ছিলেন। পাশাপাশি চাষাবাদ ও খামারের বিশাল সম্পত্তির মালিক ছিলেন। মসজিদ নির্মাণের পিছনে মূল কারণ কী ছিল? এ সম্পর্কে জানতে চাইলে লোকমুখে নানান জনশ্রুতি রয়েছে। কেউ বলছেন, মহাশিং নদী থেকে অলৌকিকভাবে ৭টি গুপ্তধন পানিতে ভেসে উঠেছিল। আর এগুলো ইয়াসিন মির্জা ও তার ভাই ইউসুফ মির্জা ধার্মিক হওয়ার কারণে সেগুলো দেখেছিলেন এবং নিজেদের কাছে সেগুলো রেখে দেন। পরে স্বপ্নের মাধ্যমে দেখতে পেলেন এগুলো দিয়ে যেন তারা নদীর পাড়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। তাই অনেকে মনে করছেন এখান থেকেই এই মসজিদের সূচনা হতে পারে।
তবে ইয়াসিন মির্জার পরিবারের সূত্রে জানা যায়, ইয়াসিন মির্জার পিতা আদিল হাজী ছিলেন বেশ ধার্মিক। তখনকার সময়ে মুসলমানরা ছিলেন সংখ্যালঘু। পুরো পরগনার মধ্যে তিনিই একমাত্র হাজী ছিলেন। আদিল হাজীকে সবাই পায়ে হেঁটে হজ পালনকারী হিসেবে জানতো। ধর্ম-কর্মের প্রতি তার অগাধ মনোনিবেশ থেকে তিনি বর্তমান মসজিদের জায়গাটিতে একটি টিনশেড ঘর তৈরি করেন নামাজের জন্য। আশপাশের গ্রামের মুসলমানরাও এখানে এসে নামাজ আদায় করতেন।
পরম্পরাগত ঐতিহ্যের সূত্র ধরেই ইয়াসিন মির্জার মসজিদ নির্মাণের স্বপ্ন জাগে। যে ব্যাপক স্থাপত্য নকশা তিনি হৃদয়পটে এঁকেছিলেন, তাতে মসজিদের নিচতলায় হিফজখানা আর উপরের তলায় নামাজের স্থান নির্ধারিত ছিল। মসজিদের বাহিরের অংশকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় করার অভিপ্রায় ছিল ইয়াসিন মির্জার। বাহিরের অপরূপ শৈলী যেন সর্বসাধারণকে মসজিদে আসতে উদ্বুদ্ধ করে। এমন প্রত্যাশা ছিল তার মন-মগজে। কিন্তু সে স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়নের মুখ দেখার আগেই তার সময় চলে আসে পৃথিবী থেকে বিদায়ের। আর এতেই আটকে যায় মসজিদের পরবর্তী সকল কাজ। এজন্য পরে বাহিরের নকশা আর বাস্তবায়িত হয়নি।
তবে তিনি অছিয়ত করে যান তার পরিকল্পনা অনুযায়ী মসজিদের কাজ পুরোপুরি বাস্তবায়িত করার আগে যেন তাদের কবর, এমনকি ঘরবাড়ি পর্যন্ত পাকা করা না হয়। কিন্তু সেটুকু আর হয়ে ওঠেনি। দুই ভাইয়ের কবরও আজ পর্যন্ত কাঁচা বেড়া-বাউন্ডারীহীন রয়ে গেছে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনটি এখনও সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দৃষ্টিতে আসেনি ও স্থাপত্য কীর্তিটি এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে সরকারি আনুকূল্য পায়নি।
মসজিদ দেখতে আসা দর্শনার্থীরা জানান, এটি দেখতে প্রায় তাজমহলের মতো। এর ভিতরে যে কারুকার্য রয়েছে তা মনোমুগ্ধকর। বিশেষ করে এই দুর্লভ পাথরের সাজ দেখে যে কারো মন কেড়ে নিবে। যদি এই প্রাচীন নিদর্শনটি সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নজরে পড়ে, তবেই দেশের পর্যটন ক্ষেত্রের আরেকটি জায়গা পূরণ হবে।
ঐতিহ্যবাহী পাগলা বড় জামে মসজিদটি অযত্নে ও অবহেলায় থাকায় আনুষঙ্গিক কাজগুলো মসজিদের নিজস্ব ফান্ড বা চাঁদা কালেকশনের মাধ্যমে সম্পাদন করা হয়। সরকারের তরফ থেকে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ পেলে ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাটি পর্যটন শিল্পে একটা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারতো। আর যদি অবহেলার ধারাবাহিকতায় দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়তে থাকে ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করা হয়, তবে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষী দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পাগলা বড় জামে মসজিদটি কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাবে।
মসজিদের উদ্যোক্তা ইয়াসিন মির্জার বংশধরেরা বলেন, প্রাচীন এই নিদর্শনটি অবহেলিত ও সরকারের নজরহীন। যদি এই প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনটি সরকারের দৃষ্টিগোচর হয় তাহলে এই মসজিদটি পর্যটকদের অন্যান্য স্থান হতে পারে। এর সৌন্দর্য ধরে রাখতে সরকারের অতিদ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
এসএটি/আরএইচ