কদিন আগে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। ব্রিটেনে সুপার শপগুলোতে ক্রেতাপ্রতি তিনটির বেশি টমেটো বিক্রি না করার বিধি-নিষেধের ওপর একটা খবর দেখেই স্ট্যাটাসটা দেওয়া। প্রথমে কোভিড, তারপর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে যখন বিপর্যস্ত বিশ^ অর্থনীতি, তখন তা থেকে কেউই নিস্তার পায়নি, পাওয়ার কথাও না, তা সে লন্ডনেই হোক আর ঢাকাতেই হোক। স্ট্যাটাসটা দেওয়ার উদ্দেশ্য অবশ্যই ইংরেজ জাতিকে খাটো করা ছিল না। উদ্দেশ্যটা ছিল এই কঠিন সময়ে আমরা যে বাংলাদেশে বসে এত কিছুর পরও তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট ভালো আছি সে বিষয়টা তুলে ধরা। খেয়াল নেই, তবে যতদূর মনে পরে কোনো একটা নির্ভরযোগ্য সোর্স থেকেই তথ্যটা সংগ্রহ করে স্ট্যাটাসটা দিয়েছিলাম।
এমনিতেই ফেসবুকে যে কোনো স্ট্যাটাস দেওয়ার বিষয়ে খুব সচেতন থাকি। চেষ্টা করি যাতে কোনো ভুল তথ্য না ছড়াই, আর এ ধরনের স্ট্যাটাস হলে তো কথাই নেই। এ কাজটি অবশ্য করি সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়ে নয়। তারপরও স্ট্যাটাসটি দেওয়ার পর অপ্রত্যাশিতভাবে কিছু কটু মন্তব্যের শিকার হতে হয়েছিল। স্পষ্ট মনে আছে, স্ট্যাটাসটির সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন কেউ কেউ। এমনকি একজন তো লিখেই বসলেন, ‘তিনটি নয়, বিধিনিষেধটা নাকি ক্রেতাপ্রতি তিন কেজি টমেটোর উপর’। কদিন আগে যখন লন্ডনে যাওয়া হলো তখনই ঠিক করেছিলাম বিষয়টা একটু খুটিয়ে জানতে হবে।
বহু বছর আগে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে প্রথমে লেখাপড়া এবং তারপর কিছু দিন কাজ করার সুবাদে বছর খানেকের জন্য লন্ডন বাসের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। নুজহাত আর আমি তখন সদ্য বিবাহিত। কিছুদিন ছিলাম ইস্ট লন্ডনে স্ট্র্যাটফোর্ডে দুই কামরার একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে। নিত্য কেনাকাটার জন্য প্রায়ই যাওয়া হতো কাছেই স্ট্র্যাটফোর্ড শপিং সেন্টারে। এবার বহুদিন পর লন্ডন গিয়ে গিয়েছিলাম স্ট্র্যাটফোর্ডে রমফোর্ড রোডের ওই অ্যাপার্টমেন্টটি দেখতে। স্ট্র্যাটফোর্র্ডে শপিং সেন্টারও ঘুরে এলাম। না গিয়ে অবশ্য উপায়ও নেই। স্ট্র্যাটফোর্র্ড আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে রমফোর্ড রোডে যাওয়ার শর্টকাটটা এই স্ট্র্যাটফোর্র্ডে শপিং সেন্টারটির মধ্য দিয়েই। সেই পরিচিত স্ট্র্যাটফোর্ডের অবশ্য এর মধ্যে পুরোই খোলনলচে পাল্টে গেছে।
এই স্ট্র্যাটফোর্র্ড এলাকাতেই আয়োজন করা হয়েছিল লন্ডন অলিম্পিক। সঙ্গত কারণেই ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে তখন এলাকাটির। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে মধ্যবিত্ত লন্ডনারদের স্ট্র্যাটফোর্ডকে এখন চেনাই কঠিন। সারি-সারি সেমি-ডিটাচড বাসাগুলোর সামনে পার্ক করা মার্সিডিজ। একটা চার তারকা হোটেলও দেখলাম। অল্পস্বল্প আর দুই একটি জিনিসের মাঝেও টিকে আছে স্ট্র্যাটফোর্ড সেন্টারের সেইন্সবারি আর পাউন্ডল্যান্ড। এই দুটো জায়গায়ই লন্ডন জামানায় আমাদের দুজনেরই খুব প্রিয় ছিল। সেইন্সবারিতে যাওয়া হতো সাপ্তাহিক বাজারের জন্য। সে সময়টায় আমাদের দেশে স্বপ্ন আর মিনাবাজারের চল হয়নি। কাজেই সেইন্সবারি ছিল আমাদের কাছে এক অদ্ভুত বিস্ময়কর জায়গা। পাউন্ডল্যান্ডটা ছিল আরও বড় আকর্ষণ। যাই কেনা হোক না কেন, পাউন্ডল্যান্ডে তার দাম এক পাউন্ড। আকর্ষণের কারণটা আর বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই।
রমফোর্ড রোড থেকে হেঁটে স্ট্র্যাটফোর্ড আন্ডারগ্রাউন্ড ফেরার পথে পুরনো অভ্যাসমতো প্রথম ঢু’টা মারলাম সেইন্সবারিতে। লন্ডনে আত্মীয়দের সঙ্গে আড্ডায় এরই মধ্যে জেনে নিয়েছি যে, টমেটো বিষয়ক স্ট্যাটাসটি পুরোপুরি সত্যি ছিল। শুধু তাই না, সেইন্সবারির মতো লন্ডনের সব সুপারশপে এখন আছে ‘ফুড ব্যাংক’। সেখানে সচ্ছল ব্যক্তিরা দান করেন আর যাদের প্রয়োজন তারা সেখান থেকে তাদের প্রয়োজন মতো জিনিসপত্র নিয়ে আসতে পারেন। এবার আর ভুল করিনি, ফুড ব্যাংকের একটা ছবি ঝটপট তুলে নিলাম। তারপর পাউন্ডল্যান্ডে ঢুকতেই অভিজ্ঞতাটা অন্যরকম। আগের চেয়ে অনেক বেশি জমজমাট পাউন্ডল্যান্ড।
শুধু যে ক্রেতার ভিড় বেড়েছে তাই নয়, বেড়েছে পণ্যের বাহারও। পাউন্ডল্যান্ডে এমনকি পাওয়া যাচ্ছে সুপারশপগুলোর মতো খাবার-দাবারও, যা আমাদের লন্ডন জামানায় ছিল অচিন্তনীয়। বরং এই সেকশনগুলোই বেশি জমজমাট। কারণটাও অবশ্য স্পষ্ট। যারা সামাজিক কারণে ফুড ব্যাংকে ইতস্তত করছেন, তাদেরই গন্তব্য এখন পাউন্ডল্যান্ড।
লন্ডনে বরাবরের মতোই এবারও আন্ডারগ্রাউন্ডে ঢের ঘোরাঘুরি করেছি। আর তাতে দুটো নতুন জিনিস খুব বেশি করে চোখে পড়েছে। আগে লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ডে উঠলেই চোখে পরত, যে যার মতো একটা চোখের সামনে একটা বই খুলে তাতে মনোযোগী হচ্ছেন। আন্ডারগ্রাউন্ডে আরেক ধরনের যাত্রী দেখা যেত, যাদের চোখের সামনে মেলা থাকত কোনো ট্যাবলয়েড পত্রিকা। এবার দেখলাম এই দুই প্রজাতির যাত্রী লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে প্রায় হারিয়ে গেছেন। আর সেই জায়গাটা দখল করে নিয়েছেন আরেক প্রজাতির যাত্রী, যাদের চোখের সামনে মুঠোবন্দি সেলফোন। লন্ডনে আন্ডারগ্রাউন্ডে দ্বিতীয় যে জিনিসটি চোখে পড়েছে, তা হলো ভাড়া। লন্ডন বরাবরই দামি শহর। তারপরও এই শহরটায় বিশেষ করে গণপরিবহন আর খাবারের দাম বরাবরই ব্রিটিশদের আয়ের তুলনায় ছিল অনেক কম।
এবারে সেই জায়গাটাতেই অনেক বড় একটা পরিবর্তন। গণপরিবহনের ভাড়া এখন শুধু আমাদেরই না, সাধারণ ইংরেজদেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেইন্সবারি থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ সবখানে খাবারের ক্ষেত্রেও একই কথাই প্রযোজ্য। পার্থক্য শুধু একটা জায়গায়, আমাদের বিরোধী দল বাস্তবতা বুঝেও না বোঝার ভান করে এসব বিষয়ে মানুষকে খ্যাপানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। আর একদল মুনাফালোভী ব্যবসায়ী মানুষের গলায় পাড়া দিয়ে লুটছে বাড়তি মুনাফা, যা ব্রিটেনের কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যবসায়ী করেন না। আরও একটা বড় পার্থক্য আছে। হঠাৎ গরিব হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর পাশে আমাদের দেশে এসে দাঁড়িয়েছেন সরকার। আমাদের বিত্তবানদের দেখা এই জায়গাটায় মেলাই ভার। আর ব্রিটেনে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটায় এগিয়ে আছে সমাজের বিত্তবানরাই। আমাদের ওরা লুটছে আর ওদের ওরা লুটাচ্ছে।
লন্ডনে যাব কিন্তু বাকিংহাম প্যালেসের সামনে একটা ছবি তুলব না এমনটা তো হতে পারে না। ওই একটা ছবি ছাড়া তো বাঙালির লন্ডন দর্শন পূর্ণতা পায় না। এবারও যথারীতি বাকিংহাম প্যালেসের সামনে গিয়ে হাজির হলাম। দিনটা লন্ডনারদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়। ইংল্যান্ডের চিরচেনা ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর ভেজা-ভেজা অন্ধকার দিন একেবারেই গায়েব। সেই জায়গায় ঝকঝকে রোদেলা দিন, ঠিক যেন বাংলাদেশের শরৎকাল। বাকিংহাম প্যালেস সংলগ্ন গ্রিন পার্কে মানুষের ভিড়। প্রত্যেকে দিনটাকে যতটুকু পারা যায় উপভোগের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।
বাকিংহাম প্যালেসের সামনে যেতেই অবশ্য বিপত্তি। গ্রিন পার্কের দেওয়াল ঘেঁষে জড়ো হয়েছেন গোটা পঞ্চাশেক মানুষ, যাদের বেশিরভাগই আবার এশিয়ান। প্রত্যেকের গন্তব্য বাকিংহাম প্যালেস, কিন্তু তারা যেতে পারছেন না। কারণ, এলাকাটা পুলিশ ঘিরে রেখেছে। বাকিংহাম প্যালেসের গেটের সঙ্গে এক খ্যাপাটে লোক হ্যান্ডকাফ দিয়ে নিজেকে আটকে ফেলেছে আর হুমকি দিচ্ছে তাকে সরাতে গেলে সে নিজের ক্ষতি করবে। বিষয়টা জানতে অবশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্য নিতে হলো। কারণ, পুলিশকে প্রশ্ন করলে গৎবাঁধা সেই একই উত্তর দিচ্ছে, ‘একটি বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ায় প্যালেসের দিকে যাওয়া যাবে না’। মোবাইলের ক্যামেরাটা জুম করে প্রথমে নিশ্চিত হয়ে নিলাম লোকটা আমাদের দেশী কিংবা আরব কিনা! দেখে মনে হলো ল্যাটিন বা হিসপানিক হতে পারে।
বিষয়টা নিশ্চিত হওয়ার পর আশপাশের আরও কজন স্বজাতীয়র মতো আমিও একটু ফেসবুক লাইভ করার লোভটা সংবরণ করতে পারলাম না। মিনিট খানেক পর খেয়াল করলাম এরই মধ্যে দেশে থেকে শ’খানেকের ওপর ভিউ হয়ে গেছে। দেশে বসে নানা জন নানা প্রশ্ন করছেন। জানতে চাচ্ছেনÑ কি হচ্ছে, কি হতে পারে ইত্যাদি। অথচ এই যে প্রাসাদের পাশেই গ্রিন পার্ক, যেখানে রোদ পোহাচ্ছেন হাজার হাজার ইংরেজ, তাদের এ বিষয়ে কোনো ভ্রƒক্ষেপ আছে বলে মনে হলো না। বাঙালির যে কোনো বিষয়ে অতি আগ্রহের কথা জানা, কিন্তু তাই বলে রাজপ্রাসাদের সামনে এমন একটা ঘটনা ঘটবে আর তাতে দু’কদম দূরে কারও কোনো কিছুই আসে যায় না এমনটা আমার কাছে চিন্তারও অতীত।
লন্ডনে এ দফায় কাটানো দিনগুলো এক হাতের আঙুলে গুনতেই শেষ হয়ে গেল। ফিরে এসে লিখতে বসে ঘুরে-ফিরে আবারও সেই লন্ডন। ব্রিটেন বাংলাদেশ হয়ে গেছে আর বাংলাদেশ ব্রিটেন, এমন কোনো গাঁজাখুরি তত্ত্ব কপচানো অবশ্য এই লেখাটার উদ্দেশ্য নয়। লন্ডনে আত্মীয়দের আড্ডায় আমার এক আত্মীয় যখন খেদ ভরে বলছিলেন যে, ব্রিটেন এখন একটি তৃতীয় বিশে^র দেশে পরিণত হয়েছে, তখন সবার আগে দ্বিমত করেছি। কিন্তু এবার লন্ডনে যাওয়ার পর থেকেই একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘ওদের লয়টা যেন কোথায় কেটে গেছে আর শেখ হাসিনার মুন্সিয়ানায় তাল-ছন্দ-লয় সব মিলিয়ে আমাদের সুরের সাধনাটা দারুণ জমেছে।’
লেখক : অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ