বিশ্বজুড়ে সব মানুষের নিরাপদ ও মানসম্মত বাসস্থান নিশ্চিতের সচেতনতা বাড়াতে ১৯৮৬ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্ব বসতি দিবস পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছরের অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার সারা বিশ্বে দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর “স্থিতিশীল নগর অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও পুনরুদ্ধারে টেকসই নগরসমূহই চালিকাশক্তি” (("Resilient urban economies. Cities as drivers of growth and recovery") প্রতিপাদ্য নিয়ে দিবসটি বিশ্বব্যাপি পালিত হবে।
বিশ্ব বসতি দিবসের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল পরিকল্পিত নগরায়ন সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন নীতি প্রচার করা, যা প্রত্যেকের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করবে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে উন্নত জীবনযাত্রা এবং সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন, গৃহহীনতা এবং নগর পরিকল্পনার মতো সমস্যাগুলির সমাধানের উপর জোর দেয়া হয়। বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নিরাপদ, পরিকল্পিত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং স্থিতিশীল নগর প্রতিষ্ঠা করাই এর লক্ষ্য।
নিরাপদ বাসস্থান ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বের সকল দেশের মানুষের একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের সকল নাগরিকের নিরাপদ ও মানসম্মত বাসস্থানের প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের এ প্রত্যয়কে বাস্তবে রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১৬ সালের জাতীয় গৃহায়ণ নীতিতে সাধ্যের মধ্যে সবার আবাসনের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে, বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য।
বাংলাদেশে দিনে দিনে শহরমুখী জনস্রোত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রামে নিজস্ব আবাসনের ব্যবস্থা থাকা স্বত্ত্বেও অনেকে কাজের সন্ধানে ও আর্থসামাজিক বিভিন্ন সুবিধা যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, যোগাযোগ ব্যাবস্থা, অবকাঠামোগত সুবিধা ইত্যাদি পেতে শহরমুখী হচ্ছে। এছাড়াও কর্মস্থলের কারণে অনেককেই শহরমুখী হতে হয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশের শহুরে জনসংখ্যা ছিলো ৩৯.৭%, যা ১৯৭৩ সালে ছিলো ৮.৬%। বাংলাদেশের শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ শহর যেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২৩ হাজারেরও বেশি লোক বাস করে। জনসংখ্যার বিচারে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৭৮.৬% গ্রামে এবং ২১.৪% শহরে বসবাস করে। দ্রুত নগরায়ন বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগনকে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রতি বছর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে বিশ্ব বসতি দিবস উদযাপন করা হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুধাবন করেছিলেন যে দেশের সকল মানুষের জন্যে যদি নিরাপদ ও মানসম্মত বাসস্থানের ব্যবস্থা করা না যায় তা হলে একটা জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তাঁর হাত ধরেই ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী বর্তমান লক্ষীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গ্রামে ভূমিহীন-গৃহহীন, অসহায় ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয় যা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকান্ডের পর স্থবির হয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধুর জনবান্ধব ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমগুলো পুনরায় চালু করেন। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার জেলার সেন্টমার্টিনে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন এবং একই বছর তিনি সারা দেশের গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে শুরু করেন “আশ্রয়ণ প্রকল্প”।
সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষগুলোকে উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসার জন্য ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন মডেল’কে সামনে রেখে সরকার সুদূরপ্রসারী বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৯৯৭ থেকে এ পর্যন্ত শুধুমাত্র ব্যারাক, ফ্ল্যাট, বিভিন্ন প্রকার ঘর ও মুজিববর্ষের একক গৃহে মোট ৫ লক্ষ ৭ হাজার ২৪৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার মাধ্যমে তাদেরকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একটি গৃহ কীভাবে সামগ্রিক পারিবারিক কল্যাণে এবং সামাজিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হতে পারে তার অনন্য দৃষ্টান্ত ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য বিমোচনের এই নতুন পদ্ধতি ইতোমধ্যে ‘শেখ হাসিনা মডেল’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। তার পাশাপাশি সরকার গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শহরের বস্তিবাসী ও স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাটে বসবাসের ব্যবস্থা করছে। প্রাথমিকভাবে রাজধানী ঢাকায় বস্তিবাসী ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ১ হাজার ১টি ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হচ্ছে যার মধ্যে ৩০০টি ফ্ল্যাট ইতিমধ্যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
নগরবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে বর্তমান সরকার ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, চট্রগ্রামের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, চট্রগ্রামের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে মত পরিকল্পিত উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বঙ্গবন্ধু টানেলে মাধ্যমে সাংহাইয়ের আদলে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ কক্সবাজারকে একটি আধুনিক পর্যটন নগরী হিসেবে রূপান্তরিত করতে সরকার অনেকগুলো মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ, মেরিন ড্রাইভকে চার লেনে উন্নীতকরণ, ট্যুরিজম পার্ক ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন ইত্যাদি সরকারের সুদূর প্রসারী উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ।
কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সামুদ্রিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার এবং মেগা প্রকল্পগুলোর সর্বোচ্চ স্থানীয় সুফল নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)। পরিবেশ-প্রকৃতির সংরক্ষণ করে ভুমির উপযুক্ত ব্যবহার ও পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যেই ২৫ বছর-মেয়াদী কক্সবাজার জেলার মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে কউক। তার পাশাপাশি পর্যটনের প্রসার, উন্নত আবাসন এবং মেরিটাইম ফ্যাসিলিজ চালুর লক্ষ্যে হাতে নেয়া হচ্ছে ৩০টি প্রকল্প। প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে কক্সবাজার থেকে মহেশখালী ও টেকনাফ পর্যন্ত ক্যাবল কার চালুকরণ, আন্তর্জাতিক মানের কনভেনশন সেন্টার ও রিক্রেয়েশন জোন তৈরি, থিম পার্ক ও ইকো রিসোর্ট নির্মাণ, কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন সীপ্লেন চালকরণ, সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বৃত্তাকার রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প অন্যতম। ব্লু-ইকোনমির সুফল ঘরে তুলতে নেয়া হচ্ছে ডিপ সী ফিশিং, সী ওয়েড চাষ, ক্রুজ লাইনার চালুকরণসহ নানা উদ্যোগ। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে আগামী এক দশকের মধ্যে কক্সবাজার আবির্ভূত হবে দেশের ইকোনোমিক গেমচেঞ্জার হিসেবে।
সরকারের ধারাবাহিক উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে গ্রামাঞ্চলেও। সরকার গ্রামের মানুষের জন্য উন্নত রাস্তাঘাট, সুপেয় পানি, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, ডিজিটাল সেন্টার ও দ্রুতগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা, মানসম্পন্ন ভোগ্যপণ্যের বাজার সম্প্র্রসারণসহ আধুনিক সব সুবিধা গ্রামগুলোতে পৌছে দিচ্ছে। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। গ্রামীণ জনপদে টেকসইভাবে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারিত করতে নেয়া হয়েছে ‘আমার গ্রাম আমার শহর' প্রকল্প।
পরিকল্পিত নগরায়নের মাধ্যমে সকল নাগরিকের আবাসন ও জীবনমান উন্নয়নে গৃহীত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। বস্তিবাসী ও দরিদ্র মানুষের আবাসন সমস্যার সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে ভূমি বরাদ্দ প্রদান, সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করা এবং উপযুক্ত পরিবারের পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।
বিভাগীয় শহরকেন্দ্রিক নগর পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে গোটা দেশের নগরগুলোর পরিকল্পনার কথা ভাবতে হবে। গণপরিবহন সুবিধা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতি ছাড়া পরিকল্পিত নগরায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শহরগুলোতে পর্যাপ্ত পার্ক তৈরি করতে হবে এবং নগরবাসীদের বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করতে হবে। ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে কমবে ঢাকামুখী মানুষের ভিড়। উল্লেখিত নাগরিক সুবিধাসমূহ নিশ্চিতকল্পে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশগুলোর বাস্তবায়িত নগরায়ন মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার সংকল্প নিয়ে দেশ জুড়ে সকলের জন্য নিরাপদ আবাসন ও উন্নত শহর তৈরিতে নানামূখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ প্রকল্প, এলাকাভিত্তিক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন, ড্যাপ, ডেল্টা প্লান ইত্যাদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার আধুনিক ও পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলার কাজ করে যাচ্ছে। টেকসই নগর গড়ে তোলার জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজন বেসরকারি উদ্যোগ ও সর্বসাধারণের অংশগ্রহণ। তাহলেই কেবল টেকসই নগরায়নের সুফল পৌছে দেয়া যাবে জনসাধারণের দোরগোড়ায়।
লেখক পরিচিতি: কমডোর মোহাম্মদ নুরুল আবছার (অব.),
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও চেয়ারম্যান, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।