২০০২ সালে প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার সারাদেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সেসময় বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ সংশোধন করে পলিথিন ব্যাগ বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। এই আইনে বলা হয়, পলিথিন উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সবনিম্ন শাস্তি ১০ হাজার টাকা জরিমানাসহ ৬ মাস সশ্রম কারাদণ্ড এবং পলিথিন ব্যবহারকারীকে তাৎক্ষণিকভাবে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে।
এই আইনের বলে সেসময় বিএনপি সরকার ৯৩১ টন পলিথিন জব্দ ও ৫২টি কারখানা উচ্ছেদ করেছে। সেসময় অল্প কিছুদিন চট ও কাগজের ব্যাগের ব্যবহার দেখা গেলেও সরকারিভাবে কোন বিকল্প ঠিক করে না দেওয়ায় এবং যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে আইন কেবল আইনের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলো।
২০১৬ সালে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে মোবারক আহমদ খান পাট থেকে পরিবেশবান্ধব ও পচনশীল 'সোনালি ব্যাগ' উদ্ভাবন করেন। যা ২০১৮ সাল থেকে বাজারজাত করণও শুরু হয়। সেসময় বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় ভাবে সোনালি ব্যাগ উৎপাদনে কারখানার জন্য প্রকল্প প্রস্তাব তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। সে প্রস্তাব তৈরিতেই কেটে যায় ছয় বছর। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে। তারপর আবার দেড় বছর পরিকল্পনা কমিশনে আটকে থাকে প্রস্তাবটি।
এদিকে ২০২০ সালে লোকসানের কারণ দেখিয়ে পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয় সরকার। যার ফলে আগে চড়া দামে পাটের ব্যাগ পাওয়া গেলেও এবার সে রাস্তাও বন্ধ হয়ে যায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ আমলে পলিব্যাগের উৎপাদন বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। পলিথিন ব্যবহারে আইন থাকলেও উল্টো সেসময় দেখা যায় সব ধরনের পলিথিন-প্লাস্টিক ব্যাগ, ও মোড়ক সামগ্রীর ওপর পাঁচ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়।
পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার বাড়লে পলিথিন উৎপাদন বন্ধ না করে এসডিজি গোল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার পরিবেশ সুরক্ষায় ও প্লাস্টিক দূষণ রোধে জাতীয় মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কিন্তু এই কর্মপরিকল্পনা খুব একটা ফলপ্রসূ ছিল না। ২০২০ সালে প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের পরিমাণ ছিল মাত্র তিন লাখ টনের মতো, যা মোট ব্যবহারের প্রায় ২০ ভাগ।
বর্তমানে পলিথিন আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। সে বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আবারও প্রশ্ন উঠেছে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে সোনালি পাটের ব্যাগ ব্যবহারে। কিন্তু তা কতটুকু সম্ভব?
আইন থাকার সত্ত্বেও কেন পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে উপরের ইতিহাস থেকে অনুমেয়। তবে এর মধ্যে আরও দুটো কারণ আছে। প্রথমত পাটের ব্যাগ উৎপাদনে খরচ প্রচণ্ড বেশি। দ্বিতীয়ত সিন্ডিকেট। পলিথিন ব্যবহার নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে পলিথিন প্রস্তুতকারী মালিকদের হামলার মুখে পড়তে হয়েছে সাংবাদিকদের। এমনকি সাংবাদিকের গায়ে আগুন অবধি দেওয়া হয়েছে। এবার বুঝুন এতে কতখানি সাধ্য জড়িত।
আইন থাকা সত্ত্বেও বিগত সময়ে সরকার যথাযথ পরিকল্পনার অভাব,বিকল্প খাতের ডিজাইন ও সে খাতের প্রডাকশন কষ্ট কমাতে না পারার কারণে পলিথিন নিষিদ্ধ করা সম্ভব হয়নি।
বর্তমান অন্তর্বর্তী কালীন সরকার যদি সত্যিকার অর্থে পলিথিন নিষিদ্ধ চায় তবে তাকে বিকল্প সোনালি ব্যাগকে দাঁড় করাতে হবে এবং একে সর্বজনীন করতে প্রডাকশন কষ্ট কমাতে হবে। তাই প্রথমে পাটকলগুলো খুলে দিয়ে এর উৎপাদন বাড়াতে হবে। এবং জোগান বাড়িয়ে মানুষের নিকট সহজলভ্য করে তুলতে হবে। এর ফলে সোনালি ব্যাগের উৎপাদন খরচও কমে আসবে।
পাশাপাশি পলিথিন সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে আইন প্রয়োগ করতে হবে। আইন খাতা কলমে নয় বাস্তবে দৃশ্যমান হতে হবে। অন্যথায় বিগত সময়ের মতো কিছু টাইম ওয়েস্ট আর মানি ওয়েস্ট ছাড়া আখেরে কোন লাভ হবে না।