বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ সরাসরি ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করে। অন্যদিকে, প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ মানুষ ধূমপান না করেও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। তথ্য, উপাত্ত ও গবেষণায় দেখা গেছে, এসবের অন্যতম কারণ সিগারেটের খুচরা বিক্রি। অন্যদিকে, তরুণ প্রজন্ম ধূমপানে আসক্ত হওয়ার পেছনে অন্যতম অগ্রণী ভূমিকা রাখছে খুচরা শলাকা বিক্রি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিইআর ও বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি)-এর যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে সব পণ্য সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয়মূল্যে বিক্রি হলেও সিগারেট ও বিড়ির ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করে না উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। সিগারেট কোম্পানিগুলো খুচরা মূল্যে বিক্রেতাদের কাছে সিগারেট বিক্রি করছে, আর বিক্রেতারা তার চেয়ে বেশি মূল্যে ক্রেতাদের কাছে সিগারেট বিক্রি করছে। প্যাকেটের গায়ে উল্লেখিত সর্বোচ্চ দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর এভাবে বছরের পর বছর তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। এই গবেষণায় সিগারেট ও বিড়ির খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, তামাক কোম্পানিগুলো খুচরা মূল্যে সিগারেট বিক্রি বন্ধ কেনো চায় না? এর পিছনেও রাজস্ব ফাঁকির আরেক কৌশল রয়েছে। চলতি অর্থবছরের ১ জুনের এসআরও’র (সেলফ রেগুলেটারী অরগানাইজেশন) তথ্য অনুযায়ী মধ্যম মানের ১০ শলাকার মূল্য ৬৭ টাকা, উচ্চ মানের ১০ শলাকার মূল্য ১১৩ টাকা ও অতি-উচ্চ স্তরের ১০ শলাকার মূল্য ১৫০ টাকা এবং এই ৩ মানের সিগারেটের ওপর সম্পূরক শুল্ক ৬৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়।
সে অনুযায়ী, অতি উচ্চস্তরের প্রতি শলাকার মূল্য ১৫ টাকা ২০ পয়সা, উচ্চস্তরের প্রতি শলাকা ১২ টাকা ১০ পয়সা, মধ্যমস্তর প্রতি শলাকা ৭ টাকা ৫০ পয়সা ও নিম্নস্তরের প্রতি শলাকা ৫ টাকা। সিগারেটের এমন অদ্ভূত মূল্য নির্ধারণ বছরের পর বছর ধরে হয়ে আসছে।
বিষয়টি অদ্ভূত এ কারণেই, মুদ্রাস্ফীতির এ বাজারে ১০, ২০ বা ৫০ পয়সার কোনো প্রচলন নেই। কিন্তু কেনো এভাবে মূল্য নির্ধারণ করা হয়? কারণ ১০ বা ২০ পয়সা বাড়তি উল্লেখ করলে সেখানে ১ টাকা বাড়তি নেওয়া যায়। কিন্তু দেখা গেছে, ক্ষেত্র বিশেষে কেবল ১ টাকা নয়, দেড় থেকে ২ টাকাও বেশি নেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে প্যাকেট প্রতি নেয়া হয় ৫ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেশি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি হলে মানুষ কেনে কোনো? আসলে তামাক কোম্পানিগুলো মানুষের নিকোটিনে আসক্তি নিয়ে ব্যবসা করে। তারা জানে, মূল্য বেশি নিলেও নিকোটিনে আসক্ত এসব মানুষের কাছে খুচরা শলাকা ক্রয় স্বাদ্ধের মধ্যেই থাকে।
তাই, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এবং তামাক থেকে তরুণদের বাঁচাতে খুচরা পর্যায়ে বিড়ি-সিগারেট বিক্রি বন্ধ জরুরি বলে মত দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। এতে করে তরুণরা সিগারেট ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হবে বলেও জানিয়েছেন তারা। বিশেষ করে একজন কিশোর বা তরুণ ১ থেকে ২টি সিগারেট সহজেই কিনতে পারে। তবে খুচরা সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ হলে তরুণদের হাতের নাহালের বাইরে চলে যাবে সিগারেট ফলে তামাক ব্যবহারে তারা নিরুৎসাহিত হবে।
জনস্বাস্থ্য, বিশেষ করে কিশোর ও তরুণদের জন্য নতুন হুমকি ই-সিগারেটের মতো এমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট ও বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রয় অচিরেই বন্ধ করতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করতে হবে।
লেখক: ইকবাল মাসুদ, পরিচালক, স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টর, ঢাকা আহছানিয়া মিশন