বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, স্বাধীনতার মহান স্থপতি, গণতন্ত্র ও শান্তি আন্দোলনের পুরোধা বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী আজ। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন- মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার। তাই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সব স্তরেই শান্তির জয়গান জাগ্রত ছিল সব সময়। শান্তি, মুক্তি ও মানবতার অগ্রদূত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাই বাঙালির গভীর শ্রদ্ধা।
১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদ কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করা হয়। বিশ্বশান্তি পরিষদের এই পদক ছিল জাতির পিতার জীবনকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ। সহজ করে বললে, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এটি ছিল বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান। এ সাফল্য অর্জনের ফলে জাতির পিতা পরিণত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধুতে।
বিশ্বশান্তি পরিষদ যেমন জুলিও কুরির নামে শান্তি পদক দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সম্মানিত করেছিল, তেমনই বঙ্গবন্ধুর নামেও একটি আন্তর্জাতিক শান্তি পদক প্রবর্তন করা হোক। আর এটা করা সম্ভব হলে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবিচল আস্থার বিষয়টিকে মূল্যায়ন করা হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পদকপ্রাপ্তির দিনে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
আগের প্রেক্ষাপটটি ছিল এরকম- ১০ অক্টোবর ১৯৭২। চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম তথা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়। বিশ্বের ১৪০টি দেশের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এরপর ১৯৭৩ সালের মে মাসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
বিশ্বশান্তি পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় দুই দিনব্যাপী ‘Asian Peace & Security Conference। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ২৩ মে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের উন্মুক্ত চত্বরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশ্বশান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ পরিয়ে দেন। সেদিন রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে বলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’
আমাদের জাতির পিতা ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়েছিলেন সেই ১৯৬৯ সালে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে দিয়েছে বাঙালির ‘অবিসংবাদিত নেতা’র স্বীকৃতি। আর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আন্তর্জাতিক এই স্বীকৃতি। স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো রাষ্ট্রনেতার সেটিই ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক পদকলাভ। বঙ্গবন্ধুর এই পদক অর্জন বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করে। বঙ্গবন্ধুকে যখন জুলিও কুরি শান্তি পদক দেওয়া হয়, তখনও বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হয়নি। হাতেগোনা কয়েকটি দেশ সেই সময় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দরিদ্র দেশের সরকারপ্রধানকে বৈশ্বিক শান্তি পদক দেওয়া বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর নিরলস প্রচেষ্টা, তাঁর কর্ম ও দর্শনের স্বীকৃতি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী পরিস্থিতি নিজেই প্রত্যক্ষ করেছেন। সেসময় তিনি দুস্থ ও অনাহারিদের কাছে একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে গেছেন। মানবসেবায় তাঁর নানাবিধ অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই তিনি বলেছেন, ‘আমরা চাই, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যয় করা হোক। তাহলে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যের অভিশাপ মুছে ফেলার কাজ অনেক সহজসাধ্য হবে।’ তাই তো দেশ স্বাধীনের পর তিনি প্রথমে জোর দিয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ওপর।
বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘পৃথিবী আজ দুইভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনে আলেন্দের পরিণতি বরণ করব; কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথানত করব না।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা রেখেছেন। তিনি জীবন দিয়েছেন; কিন্তু আপসের পথে হাঁটেননি।
বঙ্গবন্ধু সব সময় যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন। তিনি যুদ্ধ পরিহার করে যে কোনো বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানে বিশ্বাসী ছিলেন। চাইতেন বঞ্চনা ও শোষণমুক্তির মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে।
বঙ্গবন্ধুর জীবন ছিল সংগ্রামমুখী। তিনি ছাত্র অবস্থায়ই রাজনীতি সচেতন ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে এসে জড়িয়ে পড়েন সক্রিয় রাজনীতিতে। শুরুতে পাকিস্তান আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙালিবিরোধী ভূমিকার কারণে অবস্থান পরিবর্তন করতে দেরি হয়নি তাঁর। তরুণ শেখ মুজিবের অবস্থান ছিল ন্যায়ের পক্ষে, জুলুমের বিরুদ্ধে। তাঁর জীবন উৎসর্গিত ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। এর জন্য নিজের জীবনের সুখ-শান্তি উপেক্ষা করেছেন। ৫৫ বছরের জীবনে রাজনৈতিক কারণে জেল খেটেছেন ৪ হাজার ৬৮২ দিন। বাংলার মানুষের দুঃখ মোচনের লড়াইয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন বলেই তিনি ১৯৬৯ সালে হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জনরায়ে তাঁরই হওয়ার কথা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জান্তা সরকার বাঙালির হাতে শাসনক্ষমতা অর্পণ না করে চাপিয়ে দেয় এক বর্বর যুদ্ধ।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের ওপর চালায় ব্যাপক গণহত্যা। শেখ মুজিব বাধ্য হয়েই ডাক দেন জনপ্রতিরোধের, স্বাধীনতাযুদ্ধের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায় প্রতিবেশী ভারতসহ বহু শান্তিকামী দেশ। বাংলাদেশ পায় শক্তিধর সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের সমর্থন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কারাগারে বন্দি থেকেও হয়ে ওঠেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা। বন্দি মুজিব বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়েন। তাঁর নামেই চলে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ এবং তাঁকে সামনে রেখেই বাঙালি হয় যুদ্ধজয়ী। শেখ মুজিবের সাহস, মনোবল এবং মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিশ্বশান্তি পরিষদের যাত্রা শুরু ১৯৪৯। পদক প্রদান শুরু হয় ১৯৫০ সালে। ১৯৫৮ সালের আগ পর্যন্ত ফ্রেদেরিক জুলিও কুরি বিশ্বশান্তি পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় শান্তি পদক ‘মেডেল অব পিস’ নামে প্রচলন ছিল। ফ্রেদেরিক জুলিও কুরির মৃত্যুর পর ওই পদকের নাম রাখা হয় জুলিও কুরি শান্তি পদক।
শান্তি পদকপ্রাপ্ত কয়েকজন হলেন চেকোশ্লোভাকিয়ার জুলিয়াস ফুচিক, স্পেনের পাবলো পিকাসো, চিলির পারলো নেরুদা, আমেরিকার পল রবসন, তুরস্কের নাজিম হিকমত, আমেরিকার মার্টিন লুথার কিং, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ত্রো, মিশরের গামাল আবদেল নাসের, চিলির সালভাদর আলিন্দে, বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান, ফিলিস্তানের ইয়াসির আরাফাত, সোভিয়েত ইউনিয়নের লিওনিড ব্রেজনেভ, তাঞ্জানিয়ার জুলিয়াস নায়েরে প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু এই পদকপ্রাপ্তির আগে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো, ভিয়েতনামের সংগ্রামী নেতা হো চি মিন, চিলির গণ-আন্দোলনের নেতা সালভেদর আলেন্দে, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাতের মতো শান্তিকামী নেতারা এই পদকে সম্মানীত হন।
মূলত, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা এবং মানবতার ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা এই পদকে ভূষিত হয়ে আসছিলেন। আগেই উল্লেখ করেছি, বিশ্বশান্তিতে বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ ছাত্রাবস্থা থেকে। পরে রাজনীতির মাঠে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। ১৯৫২ অক্টোবরে তিনি চীনে অনুষ্ঠিত ‘পিস কনফারেন্স অব দ্য এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স’ যোগ দেন।
ওই সম্মেলনে ৩৭টি দেশ থেকে আগত শান্তিকামী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। ১৯৫৬ সালের এপ্রিলে স্টকহোমে বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনেও অংশ নেন বঙ্গবন্ধু। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশ্বশান্তি আমার জীবনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যে কোনো স্থানেই হোক না কেন, তাঁদের সঙ্গে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।’ সেই বক্তব্য আর অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ রয়েছে তাঁর গ্রন্থে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বশান্তির এক অবিস্মরণীয় দূত। শান্তিকামী এই মানুষটির একক নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে। দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের বহুবিধ বঞ্চনার শিকার বাংলাদেশ মুক্ত হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত হয়ে শুধু নিজের জন্যই সম্মান অর্জন করেননি, একই সঙ্গে তিনি বাঙালি জাতিকেও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আজীবন স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতির শান্তিময় সমৃদ্ধ জীবন। সেই লক্ষ্যে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। বাঙালির জন্য দুর্ভাগ্য- যিনি শান্তির দূত হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে পরিচিত হয়েছিলেন, সেই মানুষটিকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে।
পরিশেষে রাজনীতিক, ইতিহাসবিদ ও গবেষক মোনায়েম সরকারের দাবিকে সমর্থন রেখে বলতে চাই, বিশ্বশান্তি পরিষদ যেমন জুলিও কুরির নামে শান্তি পদক দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সম্মানিত করেছিল, তেমনই বঙ্গবন্ধুর নামেও একটি আন্তর্জাতিক শান্তি পদক প্রবর্তন করা হোক। আর এটা করা সম্ভব হলে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবিচল আস্থার বিষয়টিকে মূল্যায়ন করা হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পদকপ্রাপ্তির দিনে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।