আজ ৮ জুন, ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবস ২০২৩। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে উদযাপন করা হচ্ছে। আজ থেকে ছয় বছর আগে সারা পৃথিবী থেকে বাছাই করা ১৫০ জন লিভার বিশেষজ্ঞ স্বাক্ষরিত একটি যৌথ বিবৃতি প্রচারের মাধ্যমে ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো এই দিবসটির উদযাপনের সূচনা। সে বছরের ৫ জুন ওয়াশিংটন, প্যারিস ও লন্ডন থেকে একসঙ্গে প্রচারিত হয়েছিল এই প্রেস রিলিজটি।
এতে বাংলাদেশ থেকে স্বাক্ষরদাতা ছিলাম আমি এবং জাপানপ্রবাসী লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর। প্রথম বছর আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবস পালিত হয়েছিল বিশ্বের ২৫টি দেশে। আর ছয় বছরের মাথায় এ বছর তা উদযাপিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। এর আগে ২০২০ ও ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবসের উদ্যোক্তা গ্লোবাল লিভার ইনস্টিটিউটের অনুমোদনক্রমে এই দিবসটি এ দেশে ‘বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল ন্যাশ ডে’ হিসেবে উদযাপিত হয়েছিল।
উদ্দেশ্য ছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই বাঙালির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন এবং পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যাপ্তির সঙ্গে ন্যাশ শব্দটা জুড়ে দিয়ে দেশব্যাপী ফ্যাটি লিভার বিষয়ক সচেতনতা আরো দ্রুত সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
বাংলাদেশে মেদভুঁড়ি, ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডেমিয়া বা রক্তে অতিরিক্ত চর্বি, হাইপারটেনশন বা অতিরিক্ত রক্তচাপ, হাইপোথাইরয়েডিজম আর মহিলাদের পলিসিস্টিক ওভারি ফ্যাটি লিভারের মূল কারণ। বিশেষ করে ডায়াবেটিক রোগীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি খুবই বেশি। আমেরিকায় ৩৩ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীর ফ্যাটি লিভার রয়েছে।
অন্যদিকে আমাদের উপমহাদেশে ৪৯ শতাংশ মানুষ, যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তারা পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারেও আক্রান্ত। হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলোর মধ্যে হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস অনেক সময়ই ফ্যাটি লিভারের কারণ। তবে ফ্যাটি লিভারের অন্যতম প্রধান কারণ খাদ্যাভ্যাস আর লাইফস্টাইল। আয়েশি জীবনযাপন আর অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট বা ফ্যাটযুক্ত খাবার খেলে তা থেকে লিভারে চর্বি জমতে পারে। আমাদের দেশে ইদানীং খুবই জনপ্রিয় এই ‘ফাস্ট ফুড’ কালচার, সঙ্গে আমাদের ভাতনির্ভরতা এ দেশে ফ্যাটি লিভারের বড় কারণ।
ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত অনেকেরই লিভারে ক্রনিক হেপাটাইটিস বা দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ দেখা দিতে পারে, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় স্টিয়াটোহেপাটাইটিস বা সংক্ষেপে ‘ন্যাশ’। পাশাপাশি লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের অন্যতম কারণ ফ্যাটি লিভার। ভারতীয় উপমহাদেশে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ১৬ শতাংশের ফ্যাটি লিভার রয়েছে। যেসব রোগীর স্টিয়াটোহেপাটাইটিস আছে, তাদের প্রায় ৩০ শতাংশ পরবর্তী সময়ে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হতে পারে। আর তাদের কারো কারো এমনকি লিভার ক্যান্সারও হতে পারে। ফ্যাটি লিভার থেকে একবার লিভার সিরোসিস হলে ১৫ শতাংশ রোগী সাত বছরের মধ্যে এবং ২৫ শতাংশ রোগী ১০ বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণের ঝুঁকিতে থাকে।
পাশাপাশি চর্বিটা যেহেতু লিভার ছাড়া হার্ট, ব্রেন আর কিডনিতেও জমে, সে কারণে ফ্যাটি লিভারের রোগীদের পাশাপাশি হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক আর কিডনির সমস্যা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, মেদবহুল শরীরে ক্যান্সারের বাসা বাঁধার ঝুঁকিও থাকে বেশি। সে কারণেই দেখা যায় ফ্যাটি লিভারের রোগীরা আর দশজন লিভার রোগীর চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই হার্ট, কিডনি কিংবা ব্রেনের জটিলতায় অথবা ক্যান্সারে ভুগে আগেই মৃত্যুবরণ করে।
আমরা আপাতদৃষ্টিতে লিভারে সামান্য চর্বি দেখে লিভারটা ভালো আছে মনে করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেই পারি, কিন্তু তা আমাদের আরো অনেকগুলো কমন কিন্তু মারাত্মক রোগ থেকে ভালো থাকার কোনো নিশ্চয়তা দেয় না।
ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় আমরা একেকজন একেক রকম ওষুধ ব্যবহার করি। কিন্তু মজার কথা, এগুলো কোনোটাই কিন্তু সেই অর্থে ফ্যাটি লিভারের ওষুধ নয়। এসব রি-পারপাসড ওষুধ, অর্থাৎ এগুলো অন্য রোগের ওষুধ, যেগুলো ফ্যাটি লিভারে ব্যবহারের কারণ, এগুলো ফ্যাটি লিভারে কাজ করবে বলে প্রাথমিক গবেষণায় প্রমাণিত। এখন পর্যন্ত ফ্যাটি লিভারের সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসাটির নাম লাইফস্টাইল মডিফিকেশন বা যাপিত জীবনের পরিবর্তন। রোগীদের বোঝার জন্য আমি সব সময় রোগীদের যে পরামর্শ দিয়ে থাকি তা হলো, রাতে খাওয়া আর ঘুমের মাঝখানে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা বিরতি দেওয়া, গরু-খাসির পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় শর্করা যেমন চায়ে চিনি আর মিষ্টি পরিহার করা আর সঙ্গে সপ্তাহে পাঁচ দিন ঘাম ঝরিয়ে হাঁটা। কেউ যদি তার শরীরের ওজন ১০ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারে, তবে এতে তার লিভারের চর্বির ৫০ শতাংশই ঝরে যায়।
আমাদের ঐতিহ্যবাহী আয়ুর্বেদ আর হেকিমি চিকিৎসাশাস্ত্রে আরো অনেক রোগের মতোই ফ্যাটি লিভারের অনেক চিকিৎসার খোঁজ পাওয়া যায়। সমস্যা হচ্ছে, এই পুথিগত বিদ্যাগুলোকে মানুষের উপকারে নিয়ে আসা। এসব নিয়ে হালে এ দেশে কিছু কাজও শুরু হয়েছে। ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় এ দেশের ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনগুলোকে রি-পারপাস করে ফ্যাটি লিভারের ওষুধে পরিণত করার কাজটা একদিকে যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অন্যদিকে তা অসম্ভব না হলেও যথেষ্টই কঠিন। আমরা এরই মধ্যে এ নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছি। দেশের একাধিক পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আর গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সায়েন্টিফিক কোলাবরেশনের মাধ্যমে আমরা এরই মধ্যে ডকিং, এইচপিএলসি ইত্যাদি শেষে এখন ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় আমাদের ডিপার্টমেন্টে কালোমেঘ, অর্জুন আর সিলিমারিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছি। সামনে আরো কয়েকটি এ ধরনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পাইপলাইনে আছে। আজকের এই দিনে আমাদের লক্ষ্যটা পুরোপুরি নির্ধারিত। ‘ভেতো বাঙালির’ অতি নিজস্ব এই লিভার রোগটিকে আমাদের মতো করেই দেশীয় ওষুধের সফল প্রয়োগের মাধ্যমে বশে নিয়ে আসা। সে কারণে এবারের এই আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবসের প্রতিপাদ্য অর্থাৎ ‘ন্যাশ প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণ’ করতে আমাদের উৎসাহে বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই।
লেখক : অধ্যাপক ও ডিভিশন প্রধান ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্যসচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ