বুদ্ধি হওয়ার পর মাকে যখন জিজ্ঞেস করতাম আমার জন্ম কত তারিখ? মা ঠিকমতো বলতে পারতেন না শুধু বলতেন, ‘বৈশাখ মাসের ৭ অথবা ৮ তারিখ হতে পারে, ঐদিন কালবৈশাখী হয়েছিল আমাদের বাড়িতে ৮০ ছড়া কলা ভেঙ্গে পড়েছিল।’পদ্মা পাড়ের মানুষ হওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকেই কালবৈশাখীর সাথে পরিচিতি। কালবৈশাখীর তাণ্ডবে ঘরের টিনের চাল উড়ে যাওয়ার ঘটনাও স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি।
বাংলাদেশ দুর্যোগপূর্ণ দেশ, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, কালবৈশাখীর সাথে আমরা পরিচিত। যুগে যুগে এদেশের মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে ঝড় উল্লেখযোগ্য। ঝড়ের সঙ্গে বরাবরই লড়াই করতে হয় এদেশের মানুষের। বিশেষ করে নদী, সমুদ্র উপকূলীয় মানুষের এই সংগ্রাম সবচেয়ে বেশি।
আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে কালবৈশাখী ঝড় অন্যতম। গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মাঝে মধ্যে বিকেলের দিকে বজ্রবিদ্যুৎসহ যে ঝড়বৃষ্টি হয় তাকে কালবৈশাখী বলে। কালবৈশাখী ও সাধারণ ঝড়ের মধ্যে পার্থক্য করার কিছু বিষয় রয়েছে। বলা যায়, ঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০ কিমি-এর বেশি এবং স্থায়িত্ব কমপক্ষে ১ মিনিট হলে সেটাই কালবৈশাখী ঝড়।
বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ুর উপস্থিতি কালবৈশাখী সৃষ্টির অপরিহার্য পূর্বশর্ত। অস্থিতিশীল বায়ুমণ্ডল আর দ্রুত পরিচলন ক্রিয়া কালবৈশাখীর উৎপত্তি ও বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।
কালবৈশাখী ঝড়ে বাড়িঘর, গাছপালা, খেতের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মানুষ ও পশুপাখি মারা যায়। ঢাকায় ২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিলের কালবৈশাখী ঝড়ে কমপক্ষে ২৪ জন মানুষ মারা যায় ও শতাধিক মানুষ আহত হয়।
কালবৈশাখীর নামকরণ
কাল শব্দের অর্থ ধ্বংস এবং বৈশাখ বাংলা মাসের নাম। বৈশাখ মাসে এই ধ্বংসাত্মক ঝড়ের উৎপত্তি হয় বলে একে কালবৈশাখী নামে অভিহিত করা হয়। এই ঝড় উত্তর—দিক থেকে প্রবাহিত হয় বলে একে ইংরেজিতে নরওয়েস্টার বলা হয়। কালবৈশাখীকে বায়ুপুঞ্জ বজ্রঝড়, পরিচলনগত বজ্রঝড় নামেও আখ্যায়িত করা হয়।
কালবৈশাখী ঝড় সৃষ্টির কারণ
চৈত্র এবং বৈশাখ মাসে সূর্য বাংলাদেশ ও তার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের ওপর খাড়াভাবে কিরণ দেয়। ফলে এই অঞ্চলের বাতাস সকাল থেকে দুপুরের রোদের তাপে হালকা হয়ে ওপরের দিকে উঠে যায়।
উত্তপ্ত হালকা বাতাস উপরে উঠে ধীরে ধীরে শীতল হয়ে কিউমুলাস মেঘ সৃষ্টি করে। বায়ুমণ্ডলের এই হালকা ও অস্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকলে কিউমুলাস মেঘ উল্লম্বভাবে কিউমুলোনিম্বাস নামক কালো মেঘ গঠন। এর ফলে বিকেলের দিকে এই অঞ্চলে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়।
এই সময় বাংলাদেশের উত্তরে এবং হিমালয়ের দিকে বাতাসের চাপ বেশি থাকে। তাই উত্তরাঞ্চল থেকে উচ্চ চাপের বায়ু প্রবল বেগে দক্ষিণ দিকে নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ধাবিত হওয়ার ফলে মিলিত স্থানে কালবৈশাখী ঝড় সৃষ্টি হয়।
বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ুর উপস্থিতি কালবৈশাখী সৃষ্টির অপরিহার্য পূর্বশর্ত। অস্থিতিশীল বায়ুমণ্ডল আর দ্রুত পরিচলন ক্রিয়া কালবৈশাখীর উৎপত্তি ও বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।
কালবৈশাখী ঝড় কখন হয়?
কালবৈশাখীর প্রভাব সাইক্লোনের থেকে তুলনামূলক কম ধ্বংসাত্মক। এই ঝড় ভূমিতে আঘাত হানে। আবহাওয়াবিদের মতে, মার্চ মাস কালবৈশাখীর প্রাক-প্রস্তুতি পর্ব। কালবৈশাখী শুধু বৈশাখ মাসেই হবে-এমন নয়।
আরও পড়ুন >>> আধিপত্য নয়, বন্ধুত্ব করি প্রকৃতির সঙ্গে
শীতের শেষের দিকে ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে সাধারণত কালবৈশাখী হয়। তবে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে মধ্য মে মাসের মধ্যে কালবৈশাখী হওয়ার প্রবণতা বেশি।
সাধারণ ঝড় ও কালবৈশাখীর মধ্যে পার্থক্য
সাধারণ ঝড় গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে হয় গভীর সমুদ্রে নিম্নচাপসহ নানা কারণে। এসব ঝড়ের সময় বিদ্যুৎ চমকানো বা বজ্রপাত নাও হতে পারে। কিন্তু কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকায় এবং বজ্রপাত হয়। এই ধরনের ঝড়ে টর্নেডো বা সাইক্লোনের মতো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি না হলেও যে অঞ্চলে এটি হয় সেখানে বাড়িঘর, ফসলি জমি বা গাছপালার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
কালবৈশাখী কখন, কোথায়, কতক্ষণ হবে সেটি পূর্বাভাস দেওয়ার মতো বৈজ্ঞানিক পন্থা এখনো নেই। আবহাওয়াবিদদের তথ্য মতে, এটি তৈরি হয় ৫-৬ ঘণ্টা আগে আর শতভাগ বোঝা যায় ২-৩ ঘণ্টা আগে।
কালবৈশাখীর স্থায়িত্বকাল অল্প এবং বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই হয়। একটি কালবৈশাখী ঝড় তৈরি হয়ে পূর্ণতা পাওয়ার পর ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পর্যন্ত এর তীব্রতা থাকে। পরে তা ধীরে ধীরে এর গতি ও তীব্রতা কমতে থাকে। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে সাধারণত শেষ বিকেলে এবং সন্ধ্যার দিকে কালবৈশাখী হয়। কিন্তু পূর্বাঞ্চলে সন্ধ্যার পরে বেশি হয়।
কালবৈশাখী ঝড়ের পূর্বাভাস
খুব অল্প সময়র (কয়েক ঘণ্টার) মধ্যে ঝড়টি তৈরি হয় বলে কয়েকদিন আগে পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। তবে কোনো অঞ্চলে খুব বেশি গরম পড়লে মানুষজন অনুমান করেন যে এই ধরনের ঝড় হতে পারে। তবে এটি নিতান্তই আবহাওয়ার অবস্থা দেখে অনুমান করা।
কালবৈশাখী কখন, কোথায়, কতক্ষণ হবে সেটি পূর্বাভাস দেওয়ার মতো বৈজ্ঞানিক পন্থা এখনো নেই। আবহাওয়াবিদদের তথ্য মতে, এটি তৈরি হয় ৫-৬ ঘণ্টা আগে আর শতভাগ বোঝা যায় ২-৩ ঘণ্টা আগে।
তবে ঝড়ের পূর্বাভাসের দেওয়ার জন্য এখন হাই ইমপ্যাক্ট ওয়েদার এসেসমেন্ট টুল (HIWAT) ব্যবহৃত হচ্ছে এবং নাসার মতো সংস্থাও এতে কাজ করছে। প্রয়োজনীয় সচেতনতা ও যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের মধ্যদিয়ে কালবৈশাখী ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। সেই ক্ষেত্রে আগাম প্রস্তুতির বিষয়টি অগ্রগণ্য।
কালবৈশাখীর মৌসুমে শুরু হয়েছে। ফলে আগাম প্রস্তুতি ও পূর্বাভাস প্রদানের মধ্য দিয়ে মানুষকে সচেতন করতে উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে জনসাধারণেরও উচিত পূর্বাভাস অবহেলা না করে গুরুত্বের সহকারে আমলে নিয়ে এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা।
ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়