সেকান্দর আলী (স্টাফ করেসপন্ডেন্ট)
তামাক নিয়ন্ত্রণে শুধু আইন প্রয়োগ নয় সামাজিক দায়বদ্ধতায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে বলে তামাক বিরোধী সেমিনারে মতামত ব্যক্ত করেন আলোচক বৃন্দরা।
ধূমপান মাদকের চেয়ে কম নয়। ধূমপায়ীদের প্রায় ৯৮ভাগই পরবর্তীতে কোনো না কোনো পর্যায়ে মাদক নেয়ার সম্ভাবনা থাকে। পরিবার, কমিউনিটি, সমাজকে ধূমপানমুক্ত ও মাদকমুক্ত রাখতে চাইলে শুধু আইন প্রয়োগ করলেই হবেনা, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে জোরেশোরে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সবাইকে এগিয়ে এসে একসাথে কাজ করতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে মোটিভেশনাল ওয়ার্ক চালিয়ে যেতে হবে। এমনটাই মতামত উঠে আসে তামাক বিরোধী সেমিনারের আলোচনায়।
আজ বৃহস্পতিবার (০৬ জুন) ময়মনসিংহ বিভাগীয় পর্যায়ে তামাক বিরোধী সেমিনার বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি বিভাগীয় কমিশনার এর পক্ষে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার তাহমিনা আক্তার। বিশেষ অতিথি হিসেবে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ইউসুফ আলী, জুম প্লাটফর্মের মাধ্যমে যুক্ত স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তামাক নিয়ন্ত্রক সেলের সমন্বয়ক মোঃ আখতার উজ-জামান উপস্থিত ছিলেন।
ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মোঃ আরিফুল ইসলাম সেমিনারে তামাক বিরোধী প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে "ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) বাস্তবায়নে করণীয় তথ্য উপস্থাপনায় তুলে ধরেন তিনি।
তামাক নিয়ন্ত্রণ কেন জরুরি বিষয়টি উল্লেখ করে জানানো হয় যে, তামাকের ধোঁয়ায় ৭ হাজারের বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক রয়েছে, যা শরীরের প্রতিটি অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে। তামাক সেবন/ধূমপানের কারণে বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগ (সিওপিডি, এজমা), ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ হয়ে থাকে। ৯০ ভাগ ফুসফুস ক্যান্সারের জন্য দায়ী ধূমপান। পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে অধূমপায়ীর হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। এক্ষেত্রে শিশু ও নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তামাক সেবনের কারণে পৃথিবীতে প্রায় ৮০ লক্ষাধিক মানুষ প্রতিবছর মারা যায়। তন্মধ্যে পরোক্ষ ধূমপানে ১২ লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। গর্ভাবস্থায় তামাক সেবন বা পরোক্ষ ধূমপান গর্ভের সন্তান ও গর্ভবতী নারী উভয়ের ক্ষতি করে। অপরিণত বা কম ওজনের শিশু জন্মদানের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের ভয়াবহতা তুলে ধরে সেমিনারে জানানো হয় যে, বর্তমানে ত্রিশ বা তদুর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে ৭০ লাখের অধিক তামাক সেবনজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে ১৫ লক্ষাধিক বা ২২% মানুষ তামাকজনিত হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুস ক্যান্সার, স্বরযন্ত্র ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার, শ্বাসযন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থ্যতা (সিওপিডি, এজমা) ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত। তাদের চিকিৎসা ব্যয় তামাক খাত থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের চাইতে বেশি। ১৫ বছরের কমবয়সী শিশুর মধ্যে ৪ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি শিশু তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, যার মধ্যে ৬১ হাজারের অধিক শিশু বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। তামাকজনিত রোগে বাংলাদেশে ১ লক্ষ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মোট মৃত্যুর ২৫.৫৪% ও নারীদের মোট মৃত্যুর ৯.৭% এর জন্য দায়ী তামাক যা উন্নয়নশীল যে কোনো দেশে তামাকজনিত গড় মৃত্যুর চাইতে বেশি।
আলোচকবৃন্দ মতামত ব্যক্ত করেন যে, ধূমপান একটা পুরাতন কালচার ছিল। জমিদার তামাক খেতেন, সেটা আভিজাত্যের বিষয় ছিল। কাজের ফাঁকেও কৃষকরা তামাক খেত। মেহমানদারিতে ছিল তামাক। নারীরাও অভ্যস্ত ছিলজর্দা মিক্সারে। এটা যে ক্ষতিকর ছিল তাতেও কেউ বলেনি বা মনে করা হতোনা। বাবা ছেলেকে হুক্কা ধরানোর জন্য বলতো। এটা তখন অপরাধ মনে হতোনা। রুমান্টিকতা, বিরহ দু’টোতেই ছিল ধূমপান। এ ধরনের কালচার থেকে আমরা বের হয়েছি কিন্তু পুরোপুরি সচেতনতা গড়ে তুলতে পারিনি।
ধূমপান উপলব্ধির বিষয়। সুস্থ থাকার জন্য তামাক ছাড়তে হবে। আমাদের কিছু একটা করতে হবে। সচেতনতার সর্বোচ্চ পযায়ে পৌঁছতে হবে। ধূমপানের ছোবল থেকে স্কুলের ছেলে মেয়েদের বাঁচাতে হবে। সম্ভব হলে জাতীয় সংগীতের আগে ২-৩ মিনিট প্রতিদিন মাদক নিয়ে কথা বলা যায়, সেমিনারে এ ধরনের মতামত ব্যক্ত করেন বক্তারা।
বক্তারা বলেন, ধূমপানের ক্ষতিকর পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে বুঝাতে হবে।সামাজিকভাবে ও স্কুল কলেজে ধূমপানের ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরতে হবে। ধূমপায়ীর পরিণতির ভীতিকর ছবি প্রদর্শন করতে হবে। সরাসরি নিষেধ করতে হবে।প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে। ধূমপান একটি অপরাধ, এটা অনেকেই জানেনা। স্কুল কলেজেও তামাক বিরোধী সেমিনার করতে হবে।
তামাক নেশা জাতীয় কৃষিপণ্য। তামাক উৎপাদনে যা আয় হয় তা সামান্য। জনস্বাস্থ্যে তার চেয়ে বেশি খরচ হয়। স্কুলের আশেপাশে তামাক বিক্রি নিষিদ্ধ করা উচিত। আইনের সঠিক প্রয়োগ দরকার বলে মন্তব্য করেন আলোচকবৃন্দ। আরো বলেন, তামাকের প্রোডাকশন কমাতে হবে। উৎস কমাতে হবে। চাষকৃত জমিতে তামাকের পাতা পড়ে জমি বিষাক্ত হয়, এ সবকিছুই ক্ষতিকর। এ থেকে উত্তরণের জন্য সমন্বিত সামাজিক আন্দোলন দরকার। আমরাও আমাদের অফিস থেকে সচেতনতা শুরু করতে পারি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন- আসুন সকলে মিলে তামাক ও ধূমপান বর্জন করি, এ আহ্বানকে জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছে দিতে কাজ করার লক্ষ্যে একাত্মতার মতামত ব্যক্ত করেন উপস্থিত আলোচকবৃন্দ। আরো ব্যক্ত করেন, তামাক বিরোধী জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের টাস্কফোর্স কমিটির সমন্বয় মিটিং নিয়মিত এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য। সেইসাথে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর থাকা।
সেমিনারে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক, স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক, ডেপুটি সিভিল সার্জন, সিটি কর্পোরেশনের সচিব, বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ, জেলা আইনজীব সমিতির সভাপতি, মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক, জেলা তথ্য অফিসের পরিচালক, বিএসটিআই প্রতিনিধি, ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি, জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা, জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা, আনসার ও ভিডিপি প্রতিনিধি, আঞ্চলিক তথ্য অফিসের প্রতিনিধি, ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের প্রতিনিধি, বিআরটিএ প্রতিনিধি, বিভাগীয় টাস্কফোর্স কমিটির সদস্যগণসহ জেলা ও বিভাগীয় বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।