বৃদ্ধ জাহের আলী, বয়স-৭০। রূপগঞ্জ ভক্তবাড়ি এলাকার বাসিন্দা। নির্যাতনের বর্ণনায় জানান, ‘আমি জিয়াউল আহসানের আয়নাঘর দেখিনি। দেখেছি ডিবি অফিসের আয়নাঘর। ২০১৯ সালে ১৩ দিন অন্ধকার ঘরে আটকে রেখে দিনের পর দিন হাত-পা বেঁধে নির্যাতন চালানো হয়েছে। নির্যাতনের শিকার আমি, আমার ছেলে ও মেয়ের জামাই। এই সময়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন ৬২ বিঘা জমি লিখে নেওয়ার অভিযোগ তোলেন তিনি। যার মূল্য ৬০ কোটি টাকা। এর বাইরে নিয়েছেন বাসার গ্যারেজে থাকা তিনটি প্রাইভেটকার’।
কথাগুলো বলার সময়ও চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ বৃদ্ধ জাহের আলীর। আর এসব অভিযোগ ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে।
দ্যা সাউথ এশিয়ান টাইমসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল হক জবরদখল করে গড়ে তুলেছেন, ‘আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটি’ নামের আবাসন প্রকল্প।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার কায়েতপাড়া ইউনিয়নে পূর্বাচলের ৩ নম্বর সেক্টরের পাশে ‘আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটি’। প্রায় তিন হাজার বিঘা জমি ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করা হচ্ছে। কয়েকটি প্লটে দাঁড়িয়ে গেছে বহুতল ভবনও।
সরেজমিনে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু জাহের আলী ও তার পরিবারই নয়, এমন নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তির তালিকা অনেক লম্বা।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ ধরনের কোনো সমবায় সমিতির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পুলিশ জানিয়েছেন এমন কোনো আবাসন প্রকল্প পুলিশের নেই।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, এই বিপুল সম্পদের মালিকানা ধরে রাখতে হয়তো পুলিশের নাম ভেঙেছে। আমাদের ধারণা এই সম্পদের মালিক মোজাম্মেল হক নিজেই।
গাজী মোজাম্মেল সিন্ডিকেটে যারা
ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের রমনা জোনাল টিমের ইন্সপেক্টর দীপক কুমার দাস, রূপগঞ্জ থানার তৎকালীন ওসি মনিরুজ্জামান মনির, ডেমরা ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের সাব রেজিস্ট্রার আফছানা বেগম, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক নয়াবাজার শাখার এক্সিকিউটিভ অফিসার সাজ্জাদুর রহমান মজুমদার, দলিল লেখক জাকির হোসেন, দলিলের সাক্ষী জসিম উদ্দিন, ইমরান হোসেন, আনন্দ হাউজিং সোসাইটির পরিচালক এবং পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ড. চৌধুরী মো. জাবের সাদেক, পুলিশ সদর দফতরের স্টেট শাখায় কর্মরত এএসআই নজরুল ইসলাম, আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটির সিনিয়র ম্যানেজার এবিএম সিদ্দিকুর রহমান, ডেমরা এলাকায় অবস্থিত ব্রিজ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কর্মচারী খোরশেদ আলম ও আবদুর রহিম। এছাড়া তারিকুল মাস্টার, সিদ্ধার্থ, গণেশ, পলাশ ও সৈকত। তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন জাহের আলী।
যেভাবে রূপগঞ্জ থানা থেকে পুলিশ সদর দপ্তরে
মামলার এজাহারে বলা হয়- রূপগঞ্জ ভক্তবাড়ি এলাকার বাসিন্দা জাহের আলীকে ফোন করে থানায় ডেকে রূপগঞ্জ থানার ওসি মনিরুজ্জামান মনির। থানার ফোন পেয়ে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ও মেয়ের জামাই আবু তাহেরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি থানায় যান। থানায় যাওয়ার পর থেকে তিনি বেশকিছু দিন নিখোঁজ ছিলেন। সেখান থেকে তাদের পুলিশ সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতেও তারা ফিরে না আসায় পরিবারের সদস্যরা থানায় জিডি করতে যান। কিন্তু থানা পুলিশ জিডি না নিয়ে উল্টো তাদের হুমকি দিয়ে বলে, এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করবেন না। আর বাড়াবাড়ি করলে পরিবারের সবাইকে মেরে গুম করে নদীতে ফেলে দেয়া হবে।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে- নিখোঁজের কয়েকদিন পর পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন, পুলিশ সদর দফতরে নিয়ে যাওয়ার পর জাহের আলী ও তার জামাইকে চোখ বেঁধে নির্জন স্থানে আটকে রাখা হয়েছে। এমনকি আটক থাকাবস্থায় ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তাদের সব জমিজমা লিখে নিতে চাচ্ছে পুলিশ।
মামলার নথিতে আরও বলা হয়- রিমান্ডে থাকাবস্থায় জাহের আলী নামের ৭০ বছরের এক বৃদ্ধ ও তার ছেলেকে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে আটকে রেখে জমিজমা লিখে নেওয়া হয়।
এরপর সাজানো প্রতারণার মামলায় তাদের দীর্ঘদিন কারাগারে আটকে রাখে পুলিশ। এছাড়াও কয়েকজন নিরীহ লোককে ধরে এনে অস্ত্রের মুখে তাদের জমিজমা ও গাড়ি-বাড়ি লিখে নেওয়ার অভিযোগে মহানগর হাকিম আদালতে মামলা করা হয়েছে। মামলায় প্রধান অভিযুক্ত হলেন, পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল হক ও তার স্ত্রী ফারজানা মোজাম্মেল। মামলায় আসামি হিসেবে ২০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সাজানো ঘটনার ওপর রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলাটি করা হয় মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাসের আদালতে।
ঢাকার আদালতপাড়ায় এক আইনজীবীর চেম্বারে বসে পুলিশি নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দেন বৃদ্ধ জাহের আলী। তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে পুলিশ সদর দফতরের চার তলায় অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেলের রুমে নিয়ে যায় রূপগঞ্জ থানা পুলিশ। সেখানে সবার হাতে হাতকড়া পরানো হয়। রাতে পুলিশ সদর দফতরে ডিবির লোকজন এসে হাজির হয়। তারা আমাদের চোখে কালো কাপড় বেঁধে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে আমাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানোর পর জমিজমা লিখে দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে পুলিশ।
ডিবির আয়নাঘরে যেভাবে নেওয়া হয় জমি
ডিবির ইন্সপেক্টর দীপক কুমার দাস আমাদের ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার ভয়ও দেখান। একপর্যায়ে ডিবি কার্যালয়ে আটক অবস্থাতেই আমরা মোট ১০টি দলিল রেজিস্ট্রি করে দিতে বাধ্য হই। ১৩ দিন আমি এবং আমার ছেলে আবদুল মতিন ও মেয়ে জামাই আবু তাহের ডিবি অফিসে আটক ছিলাম। প্রতিদিনই আমাদের নির্মমভাবে পেটানো হতো। ভয়ভীতি ও নির্যাতনের মুখে আমাদের মালিকানায় যেসব ব্যক্তিগত জমি ছিল তার সবই অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল ও তার স্ত্রীর নামে লিখে দিতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু সবকিছু লিখে দেয়ার পরও মুক্তি পাইনি। আমাদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একটি প্রতারণার মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়। আমাদের বসতভিটাসহ মোট সাড়ে ৬২ বিঘা জমি লিখে নেয়া হয়েছে। যার মূল্য অন্তত ৬০ কোটি টাকা।’
৬০ কোটি টাকার সম্পদ লিখে দিয়েও হয়নি শেষ রক্ষা
জাহের আলী জানিয়েছেন, আমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একের পর এক প্রতারণার মামলা হতে থাকে। ঢাকার শাহবাগ, ডেমরা থানায় একটি করে দুটি এবং ১১টি প্রতারণার মামলা হয় রূপগঞ্জ থানায়। জমি নিয়েই ক্ষ্যান্ত থাকেনি নিয়েছেন গাড়িও জমিজমা ছাড়াও পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত ৩টি মূল্যবান গাড়িও লিখে নেওয়া হয়। গাড়িগুলোর নম্বর হচ্ছে- ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৯২৫১ (টয়োটা হ্যারিয়ার), ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-২৫২৮ (হোন্ডা-সিআরভি), ঢাকা মেট্রো ঘ-৩৩৪৬৫২ (টয়োটা এলিয়ন)। বাসার গ্যারেজ থেকে পুলিশ যখন একে একে তিনটি গাড়ি বের করে নিয়ে যায় তখন সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে। আদালতে সেই ফুটেজ জমা দেয়া হয়েছে।
রিমান্ডে ইন্সপেক্টর দীপকের ক্রসফায়ারের হুমকি
আদালত ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই বাদির শ্বশুরকে পাঁচদিন ও স্বামী, ননদের জামাইকে তিন দিন করে রিমান্ডে নেয়ার অনুমতি দেন। ওই দিনই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দীপক কুমার দাস তাদের আদালত থেকে রিমান্ডে নিয়ে যায়। একদিন পর ২৬ জুলাই মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে আসমিরা পরস্পর যোগসাজসে সম্পত্তি আত্মসাৎ করার লক্ষে বাদির শ্বশুরকে রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় নিয়ে দুটি দলিল রেজিষ্ট্রি করে নেয়। এছাড়া ব্যাংকে বন্ধক রাখা পাওয়ার বাতিল করার জন্য নতুন পাওয়ার দলিল তৈরি করেন।
ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে দলিলে স্বাক্ষর
২০১৮ সালের ১৫ জুলাই বাদির স্বামীকে ডিবি পরিচয়ে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকা থেকে জোর করে তুলে নিয়ে চারটি দলিল রেজিস্ট্রি করে নেয়। ২০১৮ সালের ১১ জুলাই বাদির শ্বশুর ও স্বামীকে চোখ বেঁধে নির্জন স্থানে আটক করে রাখে পাঁচটি দলিল সম্পাদন করে নেয় আসমিরা। ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে নিয়েছে যাদের জমি সরকারি জমি দখল করে বাউন্ডারি করে ফেলেছে। এছাড়াও ওই এলাকার আর এস ৬৬ দাগে সিহাবদের ৮০ বিঘা জমি ও দেলোয়ার হোসেনের ৫ শতাংশ, আফিয়া বেগমের ৫ শতাংশ, আবুল মাস্টার, ২০ শতাংশ, সারওয়ার হোসেনের ১০ শতাংশ, মোক্তার হোসেনের ৮ শতাংশ মোজাম্মেলের বাগান বাড়িতে।
পুলিশে এলেন যেভাবে মোজাম্মেল হক
১৭তম বিসিএসে পুলিশের সহকারী কমিশনার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ১৯৯৭ সালে চাকরিজীবন শুরু করেন গাজী মো. মোজাম্মেল হক। বর্তমানে তিনি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে কর্মরত। পাশাপাশি নিযুক্ত রয়েছেন একটি আবাসন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে। ‘আনন্দ পুলিশ পরিবার বহুমুখী সমবায় সমিতির’ নাম প্রচার করে গড়ে তোলা আবাসন প্রকল্পটির বর্তমান বিক্রয়যোগ্য সম্পদের পরিমাণ প্রায় ছয় হাজার ৬৫০ কোটি টাকা।
রূপগঞ্জের বাসিন্দা ভুক্তভোগীরা হাজি সোলেমানের। তিনি বলেন, রূপগঞ্জের গড়ে উঠা ‘আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটি’ জায়গাতে আমার বসতভিটা এবং মাছের খামার ছিল।সেই জমি অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হত্যার হুমকি ও নির্যাতন করে দখল করে নিয়েছে। মাছের খামার ছিল। তিন-চার বিঘা জমি ছিল। সব দখল করেছেন ডিআইজি মোজাম্মেল।
তিনি আরো বলেন, জমি রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন থেকে পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত অভিযোগ করেও কোনো সুফল মেলেনি।