পহেলা জুলাই থেকে পাঁচ আগস্ট। ছাত্র-জনতার সংগ্রামে উত্তাল ছিল রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ। আন্দোলন দমাতে পুলিশের মারমুখী ভূমিকা পরিস্থিতিকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়। নির্বিচার গুলিতে প্রতিদিনই ঝরতে থাকে ছাত্র-তরুণদের তাজা প্রাণ। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। স্থবির হয়ে পড়ে আমদানি-রপ্তানি। এমন পরিস্থিতিতে প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাত। গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনা সরকার। তিন দিন পর ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে গতিশীল করার প্রত্যয়ে সচল হয় শিল্প খাত। তবে মাস পেরোনোর আগেই তৈরি পোশাক শিল্পে দেখা দিয়েছে নতুন সঙ্কট। শ্রমিক অসন্তোষের প্রভাবে একের পর এক কারখানা বন্ধ হওয়ায় সার্বিকভাবে উৎপাদন ও রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন।
ডলার সংকট, কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানা সমস্যায় আগে থেকেই জর্জরিত ছিল তৈরি পোশাক খাত। করোনা মহামারি দেশের প্রতিটি খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও সবচেয়ে বেশি আঘাত লাগে রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর উদ্যোক্তারা যখন ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করেন, ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা শুরু হয়। এরপর ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে আসে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ। এসব কারণে প্রায় আড়াই বছর ধরেই আন্তর্জাতিক বাজার কাঁচামালসহ সব পণ্যের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। অন্যদিকে ডলার সঙ্কটের কারণে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। ফলে এক রকম লড়াই করেই রপ্তানি টিকিয়ে রাখছিলেন শিল্প মালিকরা। এরসঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তৈরি পোশাক শিল্প বিশাল ক্ষতির মুখে পড়ে। সর্বশেষ এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ।
তথ্য বলছে, শ্রমিক অসন্তোষসহ নানা কারণে গত এক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক শিল্প কারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে দুই শতাধিক কারখানায় উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। ফলে শিল্পের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এমসিসিআই)। কিন্তু বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) বলছে, কারখানা বন্ধ থাকায় পোশাক খাতে প্রতিদিন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। গত ১৯ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট সব মিলিয়ে ১০-১২ দিন পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ ছিল। সেই হিসেবে দেশের চলমান সংকটে ১০-১২ দিনে উৎপাদন বাবদ ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা। তবে পোশাক খাতের প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ কত, তার সঠিক হিসেব নেই খাত সংশ্লিষ্ট কোনো সংগঠনের কাছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তৈরি পোশাক শিল্পের উৎপাদন পুরোপুরি শ্রমিকনির্ভর। শ্রমিকরা নিরাপদে কারখানায় যাতায়াত করতে না পারলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। এ কারণে যে কোন সঙ্কটজন পরিস্থিতিতে এ খাতের উৎপাদন ব্যাহত হয়। এছাড়া পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীন নানা সমস্যার কারণে মাঝেমধ্যেই শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। এতে পুরো শিল্পে অস্থিরতা দেখা দেয়। অনেক সময় সুযোগসন্ধানী কোন গোষ্ঠী এর সুযোগ নিতে পারে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মো. আইনুল ইসলাম দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, ‘পোশাক খাত যেহেতু সম্ভাবনাময় খাত, তাই এ খাতে সবার নজর পড়বেই। বিশেষ করে এ খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করলে অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করা যায়। অনেকেই এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইতে পারে।’
ড. আইনুল ইসলাম আরও বলেন, ‘পোশাক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা অতি জরুরি। যতো দ্রুত সম্ভব এই খাতের সমস্যাগুলো সমাধানের পথ খোঁজা উচিত। কারণ বিদেশি ক্রেতারা একবার মুখ ফিরিয়ে নিলে দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট তৈরি হবে। এতদিন বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রতি বিদেশি গ্রাহকদের যে আস্থা তৈরি হয়েছিল, তা ধরে রাখতে হবে। পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটি শুধু কোনো বিশেষ শ্রেণীর ক্ষতি হবে না বরং পুরো দেশের ক্ষতি হবে।’
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, “কোনো না কোনো ঘটনায় বারবার কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হলে খুব স্বাভাবিক কারণেই ক্রেতারা আস্থা হারাবেন। তারা উদ্বিগ্ন। প্রতি মুহূর্তে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন তারা। শিডিউল অনুযায়ী পণ্য হাতে না পেলে তারাও বিকল্প চিন্তা করতে বাধ্য।”