একমাস পার হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিন্তু সঙ্কট কাটছে না প্রশাসনিক কাঠামোয়। বিশেষ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দাবি আদায়ের তালিকা শেষই হচ্ছে না। কারো পদোন্নতি তো কেউ পদায়ন আবার কারও কারও ট্রান্সফারের দাবি। আন্দোলনকারীরা বলছে, গত ১৫ বছরে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক বিবেচনা ছিল মুখ্য। যা প্রশাসনের শৃঙ্খলাকে নষ্ট করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ৮ আগস্ট থেকে জনপ্রশাসনে ৪৭১ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হিসেবমতে, সাতটি মন্ত্রণালয় নেই সচিব। পরিকল্পনা কমিশনে সচিব পদমর্যাদার একটি পদ শূন্য রয়েছে।
সচিব না থাকা মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হলোা বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা বিভাগ, জাতীয় সংসদ সচিবালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।
এদিকে দেশের ৫৯ জেলায় ডিসি পদায়ন করে জারি করা প্রজ্ঞাপনের পর গত মঙ্গলবার দুপুরে উপসচিব পদমর্যাদার ৫০–৬০ কর্মকর্তা, যারা ডিসি হতে পারেননি, তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ (এপিডি) শাখায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন। বিকেল পর্যন্ত চলে এ অবস্থা।
পরিস্থিতি এমন দাড়ায় যে জনপ্রশাসন বিভাগ থেকে বলা হয় এই প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হবে। বিক্ষেোভে অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তা জানন, যাদের ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের বেশির ভাগ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রশাসনে ভালো পদে ছিলেন। অন্যদিকে তারা আগেও বঞ্চিত ছিলেন, এবারও তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ৫০ বছরে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এসবের জন্য দলীয়করণ, মেধার মূল্যায়নহীনতাকে দায়ী করছেন তারা।
বলছেন, রাতারাতি এই সংকট শেষ হবে না। কাঠামোগত সংস্কার হলে সাময়িক স্বস্তি মিলল্ওে শঙ্কা থেকে যাবে। জনপ্রশাসনে প্রথম বড় পদোন্নতি হয় গত ১৩ আগস্ট। ওই দিন ১১৭ জন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবকে উপসচিব করা হয়। এর এক সপ্তাহের মধ্যে ২২৩ উপসচিবকে যুগ্ম সচিব করা হয়। এরপর ২৫ আগস্ট ১৩১ কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব করা হয়। সব মিলিয়ে ৮ আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকার ৪৭১ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে।
গত একমাসে, ২৪ কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে উপসচিব, এরপর যুগ্ম সচিব ও সর্বশেষ পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। ৫ আগস্টের আগেও তারা ছিলেন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, বঞ্চিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি বঞ্চিত সেজে কিছু সুবিধাভোগী, বিতর্কিত ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন। পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও রয়েছেন, যার বিরুদ্ধে অপরাধে জড়ানোর অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা চলছে এমন কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন।
আন্দোলন চলছে পেট্রোবাংলা, এলজিইডি, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়সহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ–আন্দোলন করছেন। এতে ওই সব দপ্তরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, যেকোনো অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগে। প্রশাসনে যতটা বিশৃঙ্খলার কথা বলা হচ্ছে, বিষয়টি সে রকম নয়। অন্যদিকে প্রশাসনে যাঁরা বঞ্চিত ছিলেন, তারাই পদোন্নতি পাচ্ছেন। দু–একটা ভুলভ্রান্তি হতে পারে।
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, অল্প সময়ে যারা জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন, তাদের উচিত হবে নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করা। তারা যে যোগ্য ছিলেন, এখন কাজের মাধ্যমে তাদের প্রমাণ করতে হবে।
অন্যদিকে বিগত সরকারের সুবিধাভোগী কিছু কর্মকর্তা অন্তর্বর্তী সরকারেও গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন অন্তর্বর্তী সরকারের দুজন উপদেষ্টার একান্ত সচিব (পিএস) হয়েছেন। ওই দুজনের একজন বিসিএস ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের একান্ত সচিব ছিলেন। এ ছাড়া বিগত সরকারে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন ছিলেন। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টার একান্ত সচিব হয়েছেন। এ নিয়ে সমালোচনা করছেন বিগত সময়ের বঞ্চিত কর্মকর্তারা।
ভিন্নচিত্র রয়েছে অন্য ক্যাডারে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পদোন্নতিবঞ্চিত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা শুধু পদোন্নতি পাচ্ছেন। এতে শিক্ষা, তথ্য, কৃষিসহ অন্যান্য ক্যাডারে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পদোন্নতিসহ বিভিন্ন দাবিতে জোট বেঁধেছেন বিসিএস ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ৩১ আগস্ট তারা আন্ত:ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ নামের জোট ঘোষণা করে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেন।
এ পরিষদের কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়মিত পদোন্নতি হয়। পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি দিতে সুপারনিউমারারি (সংখ্যাতিরিক্ত) পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অথচ অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা সব যোগ্যতা অর্জন করেও পদোন্নতি পান না। দিনের পরদিন পদোন্নতির অপেক্ষায় থাকেন।
জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানোর বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইঞা বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে গতানুগতিক চিন্তা করলে হবে না। আবার সবার প্রত্যাশাও বেড়ে গেছে। তবে সবার দাবি একসঙ্গে পূরণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য সময় দিতে হবে।