একটা সময় ছিল যখন গাঁয়ের মেঠো পথে দেখা যেত গরুর গাড়ি। সূর্য অস্ত গেলে ঘরে ঘরে জ্বলে উঠতো হারিকেনের অগ্নিশিখা। গৃহস্থ বাড়িতে দেখা মিলত, পাটের শিঁকে আর বেতের তৈরি আসবাব। যুগ পাল্টেছে, সেই সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে পুরাতন এসব ব্যবহার্য জিনিসপত্র। যার শূন্যতা ঘুচিয়েছে যান্ত্রিক গাড়ি, বৈদ্যুতিক বাল্ব, আর কাঠের তৈরি আসবাবপত্র। কারণ আধুনিক যুগে এসে এসবের ব্যবহার যে বড্ড বেমানান।
তবে ভাবতে অবাক মনে হলেও, বাঙালির লোক সংস্কৃতির পুরোনো এসব ঐতিহ্যের নিদর্শনে আজও চোখে পড়ে রাজধানীর দোয়েল চত্বরে গড়ে উঠা ছোট একটি মার্কেটে। চত্বর থেকে সুপ্রিম কোর্ট যাওয়ার পথে রাস্তার বাম পাশ ধরে হাঁটলেই চোখে পড়বে এসব নিদর্শন। ৪০টি দোকান মিলিয়ে গড়ে উঠা এই মার্কেটটিতে রয়েছে, মাটির তৈরি হাড়ি, কলমদানি, ফুলের টব, থালা, টেপা পুতুল, হাতি, ঘোড়া, ব্যাংক, প্লেট, বাটি, গ্লাস, চামচ, বেতের ট্রে, বাঁশের তৈরি মাছ ধরার পলোসহ পাটের তৈরি নানান জিনিসপত্র।
এখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ৩০ বছর আগে কয়েকটি দোকান মিলিয়ে এখানে গড়ে এই মার্কেট। সময় গড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে দোকানের সংখ্যাও বাড়ে। এখানে যেসব জিনিসপত্র বিক্রি হয়, তা প্রস্তুত হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বিশেষ করে ঢাকার সাভারে তৈরি হওয়া মাটির জিনিসগুলো এখানে আসে। এছাড়াও, পটুয়াখালী, বরিশাল,রংপুর থেকেও এখানে পণ্য আসে। শৌখিন মানুষরাই এখানকার ক্রেতা। এছাড়াও ঢাকায় ঘুরতে আসা মানুষরাও এখানে আসেন। এসব দোকানে সর্বনিম্ন ৩০ টাকার পণ্য মিলবে একজন ক্রেতার।
ইট-পাথরে গড়া রাজধানীর জীবনযাত্রার এই মার্কেট ক্রেতাদের কাছে বাঙালির লোক সংস্কৃতির ঐতিহ্যের শোভা বর্ধনকারী একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
এর গুরুত্ব বিবেচনায় এখানের আসা ক্রেতাদের ভাষ্য, বিলুপ্তির পথযাত্রায় এসব নিদর্শন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হলে বাংলা এবং বাঙালির ঐতিহ্য টিকে থাকবে যুগে পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আর বিক্রেতাদের দাবি, অস্থায়ী মার্কেট স্থায়ী করা হলে এসব দোকান টিকে থাকবে। যা ঐতিহ্য টিকে রাখতে সহায়ক হবে।
ঢাকার খিলগাঁও থেকে এই মার্কেটে এসেছেন লাবণ্য নামের এক মেয়ে। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, “আমি ঘর সাজানোর জন্য এই মার্কেটে এসেছি। আমি মনে করি, এগুলো কেনা মানে, এসব ঐতিহ্য আমার সংরক্ষণে থাকলো। কিছুদিন আগে একটা খবর শুনেছিলাম, জামদানি শাড়ি আমাদের পেটেন্ট। কিন্তু ভারত দাবি করেছে এটা তাদের পেটেন্ট। এমনভাবে যদি চলতে থাকে তবে দেখা যাবে, এগুলো হারিয়ে গেছে। এসব সংরক্ষণের জন্য অবশ্যই আমাদের ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।”
জয়দেব পাল নামের আরেক ক্রেতা বলেন, “আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের ঐতিহ্য। এখানে যেসব জিনিসপত্র পাওয়া যায়, তার আমাদের গ্রাম বাংলার অনুষঙ্গ। এখন আপনি বেড়াতে গেলে সেখানে আপ্যায়ন হয় সিরামিকের থালা বাসনে। এগুলো আর দেখা যায় না। এগুলো টিকিয়ে রাখা হলে, বাংলা এবং বাঙালির ঐতিহ্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানবে।”
ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে আসা নাহিদ বলেন, “এখানে স্বল্প পরিমাণে দোকান। এ কয়টি দোকান দিয়ে ঐহিত্য রক্ষা সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি। এজন্য বড় পরিসরে আয়োজন করা জরুরি। কেননা এখনই সব যেভাবে হারাচ্ছে। আমাদের পরের প্রজন্ম আরও ভুলে যাবে। তাই এর জন্য পদক্ষেপ নিতে বড় পরিসরে এবং সেটা হবে কার্যকর।”
সাগর নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, “প্রায় ৩০ বছর ধরে এখানে দোকান রয়েছে আমাদের। আগে আমাদের বড়রা করতেন, এখন আমরা করছি। এখানে শৌখিন মানুষরাই বেশি আসেন। ব্যবসা এখানে ভালো হয়। দেশের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পর ব্যবসা এখন ভালো না। আমাদের কাছে বেত ও মাটির জিনিসপত্র ছাড়াও ভ্যান, টেম্পু, ঢেঁকি এসব জিনিসও আছে। যেগুলো এখন আর দেখা যায় না।”
ঢাকা মহানগর মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির সভাপতি বাহার উদ্দিন সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, "এখানে ৪০ টা দোকান মিলে মার্কেট গড়ে উঠেছে। এখানে যদি কেউ আসে তবে জিনিস না কিনলেও শিক্ষা অর্জন করে যেতে পারবে। শিক্ষা বলতে গ্রাম বাংলায় আগে ঢেঁকি ছিল এখন তা নাই। সেই ঢেঁকির সঙ্গে তার পরিচিতি হবে। এমন আরও অনেক কিছু বিলুপ্ত প্রায় জিনিস এখানে পাওয়া যায়। আমাদের দোকান গুলো অস্থায়ী। সরকারের কাছে আমরা এই মার্কেটের স্থায়ী করণ চাই। যদি স্থায়ী করা হয় তবে আরও ব্যবসা ভালো হবে এবং ঐহিত্য টিকিয়ে রাখা সহজ হবে।"