কখনও সিলিন্ডার বিষ্ফোরণে পুড়ে যাওয়া। কখনও বা বাথরুমে পড়ে মারাত্মক আহত। মেডিকেলে নেওয়া, মারামারি করে বিপদে আছেন। এমন সব প্রতারণার ফন্দি নিত্যনতুন পাতেন তারা। এই কৌশলে হাতিয়ে নেন মোটা অংকের টাকা।
এছাড়াও বলা হয়, শারীরিক নির্যাতন বা কঠিন শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে দ্রুত বিকাশে পাঠাতে হবে টাকা। এভাবেই আতঙ্ক তৈরি করে বন্দীদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগ কিছু অসাধু কারারক্ষীদের বিরুদ্ধে পুরোনো।
সিনেমার কল্পকাহিনী কিংবা বাইরে থাকা প্রতারক চক্রকেও হার মানিয়ে দিয়েছে চার দেয়ালের ভেতরে ডিউটি করা কিছু অসাধু কারারক্ষী। শুধু তাই নয়, বন্দীর পরিবারের নারী সদস্যের নানাভাবে কুপ্রস্তাব ও মোবাইলে বিরক্ত করার অভিযোগও কম নয়। স্বজনদের বিপদের কথা চিন্তা করে কেউ কেউ বাধ্য হচ্ছেন তাদের কুপ্রস্তাবে রাজি হতে। আবার কেউ করছেন প্রতিবাদ।
সম্প্রতি, এমন কয়েকটি ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও হয়েছে। এমন অভিযোগ করেন জামিনে মুক্তি পাওয়া বন্দী ও তার পরিবারের সদস্যরা।
গতকাল ১৬ আগস্ট রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে কারারক্ষীদের সামনেই নির্যাতনে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি বাহরাম বাদশা নামের এক বন্দীকে মেরে ফেলেন অপর বন্দী রফিকুল ইসলাম। এই ঘটনায় অভিযুক্ত তিন কারারক্ষীর মধ্যে দুজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।
রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার (১৬ আগস্ট) সকাল ৭টার দিকে কারাগারের অভ্যন্তরে গাছ থেকে আমড়া পাড়া নিয়ে বাহরাম বাদশার সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয় বন্দী রফিকুল ইসলামের। এরপর কারারক্ষীদের সামনেই কারাগারের অভ্যন্তরে ‘ক্যাশ টেবিলের’ নামে জেল সুপারের নেতৃত্বে বিচার বসে। সেখানে শত শত বন্দীর সামনে কারাগারের সিআইডিতে কর্মরত (যারা নিজেও সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি) মোতালেব, সুবেদার শাহাজাহান ও জামাদার মাহবুব সাজাপ্রাপ্ত আসামি বাহরামকে গামছা দিয়ে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করলে এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন। তখন কারারক্ষীরা কারাগারের পাশেই রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
দ্যা সাউথ এশিয়ান টাইমসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসা বন্দীদের মুখে উঠে আসে কিছু অসাধু কারারক্ষীদের প্রতারণা ও বন্দীর পরিবারের নারী সদস্যদের কুপ্রস্তাব দেয়াসহ চাঞ্চল্যকর তথ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাসুম হোসেন (ছদ্মনাম)। একটি মামলায় দীর্ঘ ৩ বছর কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। গতবছর আগুনে পুড়ে যাওয়ার কথা বলে বিকাশে ৪৫ হাজার টাকা নেয়ার অভিযোগ তোলেন এক কারারক্ষীর বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী বন্দী মাসুম এখন জামিনে রয়েছেন।
যেভাবে বিকাশে টাকা নেওয়া হয়:
বছর খানেক আগের কথা। তখন ঘড়ির কাটায় দুপুর ১টা থেকে ২টা। একটি অপরিচিত নম্বরে কল আসে মাসুমের ছোটোবোনের ছেলের মোবাইলে।
মাসুমের ভাগিনা সাগরের ভাষ্যমতে, কল রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে অপর প্রান্ত থেকে কারারক্ষী পরিচয় দেয়া এক ব্যক্তি বলেন, মাসুম কাশিমপুর কারাগারে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন। তার শরীরে প্রায় ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাকে সাভার হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। তার চিকিৎসার জন্য দ্রুত কল করা নম্বরে ৫০ হাজার টাকা পাঠাতে বলা হয়। টাকা পাঠিয়ে সাভার হাসপাতালে দ্রুত চলে আসতে বলেন তাদের।
সাগর বলেন, এমন খবর শোনার পরই আমার মা কান্নাকাটি করতে করতে পাশেই নানীর বাড়িতে চলে যায়। সঙ্গে আমরাও। নানী বাড়ি যাওয়ার পর মামানীকেও মামাতো ভাইদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন মোবাইলের অপর প্রান্তে থাকা কারারক্ষী পরিচয় দেয়া সেই ব্যক্তি। টাকা পাঠাতে দেড়ি হলে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। আসার আগে টাকা পাঠাতে বলা হয়।
মাসুমের মেঝ ছেলে মামুন দ্যা সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, হঠাৎ বাবার এমন খবর পেয়ে বাসায় কান্নাকাটির হুলুস্থুল পড়ে যায়। এরই মধ্যে হুট করে ৫০ হাজার টাকা ম্যানেজ করাও কষ্টসাধ্য। অনেক কষ্টে উনার দেয়া মোবাইল নম্বরে ৪৫ হাজার টাকা বিকাশ করি। পরে সাভারের উদ্দেশে রওনা করি। পথে বসে সেই নম্বরে কল করলে বন্ধ দেখায়। হাসপাতালে গেলে কর্তৃপক্ষ জানায়, কারাগার থেকে এমন কোন রোগীই আসেনি।
তিনি বলেন, এরপর ফোন দেয়া ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তে পরিচিত এক পুলিশের সহযোগিতা নেই। সেই নম্বরটি ট্রু কলার অ্যাপে সার্স দিয়ে দেখা যায় নাম আসে কারারক্ষী। পরে বাবার সাথে যোগাযোগ করা হলে এবং নম্বর বললে তিনি বলেন, বুঝতে পেরেছি। কোন কারারক্ষী নিতে পারেন। প্রতিবাদ করলেই শারীরিক নির্যাতন করবে ভয়ে কিছু বলেননি সেই কারারক্ষীকে।
দেড় বছর কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা এক বন্দী দেখেছেন কারারক্ষীদের প্রতারণার নানা কৌশল। জেনেছেন নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা। তার পরিবারের সঙ্গে এমন নোংরামির চেষ্টা করেন এক কারারক্ষী।
নিরাপত্তা ও সম্মানের দিকে তাকিয়ে আমরা তার নামের প্রথম অক্ষর ব্যবহার করছি মি. এস। তিনি দ্যা সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, আমি দেশের একটি আলোচিত মামলায় কারাগারে যাই। প্রথমে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে। কয়েকমাস পর পাঠানো হয় কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখানে নতুন হওয়াতে এক কারারক্ষীর মোবাইলে বাসায় যোগাযোগ করি। সেই কারারক্ষীর বিকাশ নম্বরে বেশ কয়েকবার টাকা আনি। তাকে হাজারে দিতে হয় ২০০ টাকা।
তিনি বলেন, সবথেকে বেশি বিপদে পড়ি দেশে তখন মহামারি করোনার প্রকোপ। পরিবারের সঙ্গে দেখা করা একদম নিষেধ। সেই সুযোগে আমার পরিবার থেকে আমার নানা বিপদের কথা বলে কয়েক ধাপে বিকাশে টাকা আনেন সেই কারারক্ষী। যার কিছুই জানতাম না আমি।
ভুক্তভোগী এই বন্দী নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে বলেন, শুধু তাই নয়, কোন কারণ ছাড়াই মধ্যরাতে আমার স্ত্রীর নম্বরে ফোন করে নানা রকমের কুপ্রস্তাব দিতেন তিনি। রাজি হলে বিনিময়ে আমাকে কারাগারে দেয়া হবে নানা সুবিধা। পরে কারাগারে থাকা এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর সহযোগিতায় সিন্ডিকেটের সদস্যদের টাকা দিয়ে নিজেই মোবাইল ব্যবহার করতে থাকি।
কারা কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি অনিয়মের কথা তুলে ধরে মি. এস বলেন, করোনাকালীন সময় বন্দীদের সঙ্গে দেখা করা নিষেধ থাকার পরেও শীর্ষ সন্ত্রাসী ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী বন্দিরা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নিরিবিলি পরিবারের সঙ্গে একান্ত সময় কাটাতেন তারা। আর আমাদের বেলাই যত নিয়ম। আসলে দুর্নীতিতে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের কারাগারগুলো।
কারারক্ষীদের বিরুদ্ধে বন্দিদের যত অভিযোগ:
বন্দীদের দেওয়া তথ্য বলছে- টাকা ছাড়া কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। বন্দীর পরিবারের সদস্যদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিকাশে টাকা নেওয়া। দেখা করতে গেলে হয়রানি করা। মানসিক অত্যাচার করা। দর্শনার্থীদের নানাভাবে হেনস্তা ও মাঝেমধ্যে শারীরিক নির্যাতনও করেন তারা।
বন্দীর পরিবারের নারী সদস্যদের অহেতুক ফোন করে বিরক্ত করা। মোবাইলে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে ৩ মিনিট১০০টাকা করে নেওয়া। বিকাশে হাজারে দুইশত করে টাকা নেওয়া। বন্দীর সঙ্গে দেখা করার সময় সরাসরি টাকা আদান-প্রদান করা। এর বিনিময়ে হাজারে দুই শত টাকা নেওয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। টাকা না পেলে সিন্ডিকেটের সদস্যের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা।
কারাগারে কারারক্ষীর কাজ কি?
বন্দীদের নিরাপদে আটক নিশ্চিত করা। কারাগারের কঠোর নিরাপত্তা ও বন্দীদের মাঝে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। বন্দীদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা। একজন সুনাগরিক হিসেবে সমাজে পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করাই কারারক্ষীদের কাজ।
কিন্তু জামিনে মুক্তি পাওয়া বন্দীরা বলছেন ভিন্নকথা। তাদের ভাষ্যমতে, কারারক্ষীদের জেলে বা কারাগারে যে উদ্দেশ্যে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তা ঠিকমত পালন করেন না তারা। পুরোনো কয়েদি সিন্ডিকেট ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আশ্রয়ে সাধারণ বন্দীদের অত্যাচার ও নানা ভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার ফন্দিতে ব্যস্ত থাকেন তারা।
কারারক্ষীদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন দ্যা সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, আপনি যেগুলো অভিযোগ তুলেছেন এগুলো সত্য। আপনার কোন অভিযোগকে মিথ্য বলব না। এগুলো নিয়ে কাজ করছি।
কারাগারে দুর্নীতি মুক্ত করার কথা তুলে ধরে মহাপরিদর্শক বলেন, আমি নতুন এসেছি। কারাগারে যেন কোন রকমের দুর্নীতি কেউ না করতে পারে সেই বিষয়গুলো নিয়ে আমি কাজ করছি। আশা করছি এই সিন্ডিকেট বন্ধ হবে।
অসাধু কারারক্ষীদের বিরুদ্ধে বন্দীদের নানা অভিযোগ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক দ্যা সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, আমরা এর আগেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখেছি অর্থের বিনিময়ে কারারক্ষী ও কর্মকর্তারা বন্দিদের নানা ভাবে সুবিধা দিয়েছেন। যে সুবিধা ওই বন্দীর জেল কোডে ছিলো না।
তিনি বলেন, এরআগে কাশেমপুর কারাগারে হলমার্ক কেলেঙ্কারির আলোচিত মামলার এক আসামি কারাগারের ভেতরে স্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সময় কাটানোর খবর ছড়িয়ে পড়ে গণমাধ্যমে। এতেই প্রমাণ হয় যে কারাগারে দুর্নীতি হচ্ছে।
এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ মনে করেন ‘এখনই সময়। এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের লাগাম টেনে না ধরলে এই ট্রেন্ড চলমান রয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।