২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ লাখে। যা নিয়ে চরম বিপাকে দেশ। ৭ বছর অতিবাহিত হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সফলতার মুখ দেখেনি। নতুন করে আবারও রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন নোবেলজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূস। তিনি এই সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দফতরে সংস্কারের মাধ্যমে শুরু করেছেন কাজ।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কতটুকু সফল হবে অন্তবর্তী সরকার, এ নিয়ে শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক আলোচনা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেবে মতে, গত আগস্ট মাসে নানাভাবে ১০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য পা্ওয়া গেছে। তবে সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন এই সংখ্যা আরও বেশি।
প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে রাজি করার জন্য ভারতের কাছে সহায়তা চাওয়া হবে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় ঢাকার জন্য ভারত ও চীন উভয়ের সহায়তা প্রয়োজন। সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের ভারত ও চীনের সহায়তা দরকার। প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাংলাদেশে এসেছে এবং এখন এই জনসংখ্যা বাড়ছে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে। কিছু দেশ তাদের নিচ্ছে কিন্তু খুব অল্পসংখ্যক। ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে, মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি করাতে আমাদের ভারতের সহায়তা দরকার।
সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ নিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জোর দিয়েছেন ড. মোহাম্মদ ইউনূস। এরইমধ্যে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা । আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের দ্রুত পুনর্বাসনের ওপর জোর দেন প্রধান উপদেষ্টা।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসনে জোর দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। আইওএম বাংলাদেশের মিশন প্রধান আবদু সাত্তার ইসোয়েভ এ সময় যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোতে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের চিত্র তুলে ধরেন। যুক্তরাষ্ট্রে সহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে তাদের দেশে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে, তবে প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হয়নি বলেও বৈঠকে জানানো হয়। প্রধান উপদেষ্টা এই প্রক্রিয়া দ্রুত করার আহ্বান জানান।
এছাড়াও সম্প্রতি জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস প্রধান উপদেষ্টা এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহযোগিতার কথা জানিয়েছেন গোয়েন লুইস। রোহিঙ্গা সংকটের সাত বছর পূর্তিতে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) দাতাদেশ, আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে রোহিঙ্গা কার্যক্রমে তাদের অর্থায়ন বাড়ানোর আহ্বান জানায়। অর্থায়নের অনিশ্চয়তার কারণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও জীবনরক্ষাকারী কার্যক্রম ছাড়া অন্য অনেক জরুরি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
অন্তর্বতী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা-ইউএনএইচসিআর চায় আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিই। কিন্তু আমরা তাদের কাছে স্পষ্ট করেছি, আমরা ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি। আমাদের যেটুকু ভূমিকা নেওয়া প্রত্যাশিত তার চেয়ে বেশি আমরা পালন করেছি। আমাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। যারা আমাদের উপদেশ দিতে আসে বা চায়, তারা বরং তাদের (রোহিঙ্গাদের) নিয়ে যাক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নানা ধরনের উদ্যোগের পরও এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারেনি। কূটনৈতিক ও আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলোচনার পরও সংকট সমাধানে কোনো অগ্রগতি হয়নি। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নতুন সরকারের সহযোগিতা চায় এবং এ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পক্ষে। তারা বিশ্বাস করেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে তাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় সহজ হবে।
কক্সবাজারের সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য সত্যিকার অর্থেই একটা উদ্বেগের বিষয়। এ ধরনের অনুপ্রবেশ যাতে না ঘটে সে জন্য সরকারকে উভয় পক্ষের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’
তথ্য বলছে, রোহিঙ্গাদের ফান্ডে অর্থ দিয়ে সহায়তা করতো দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংগঠন। অর্থ সহায়তায় অন্যতম জাতিসংঘ। এছাড়াও পোশাক, মেডিসিনসহ ত্রাণে বিভিন্ন সরঞ্জামি দিচ্ছে সংগঠনগুলো। তবে ত্রাণের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি বিক্রি করেন রোহিঙ্গারা, এমন খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে নিন্দা ঝড় উঠে। পরবর্তীতে নানা কারণে রোহিঙ্গাদের ফান্ডে অর্থ ও ত্রাণ বিতরণ বন্ধ করে বিভিন্ন সংগঠন। দূর্বল অর্থনীতি নিয়ে চলতে থাকা দেশ রোহিঙ্গাদের চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্ব হওয়ায় ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাস ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে চলেছে। প্রতিনিয়ত তারা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অস্ত্র ও মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছে। এমনকি এক শ্রেণির সুবিধাভোগীদের অর্থ দিয়ে দেশের নাগরিকত্ব নিচ্ছেন রোহিঙ্গারা। ছাড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। ফলে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে ‘সেফ জোন’ পেলে মিয়ানমারে ফিরে যাবে বলে জানান রোহিঙ্গারা।
এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ চলছে। এ পর্যন্ত ২০০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বাকিরা প্রাণ বাঁচাতে দালালের পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাবশালীদের মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে টেকনাফ পৌরসভা, সাবরাং, সদর ও হ্নীলা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিচ্ছেন তারা। এবার যেসব রোহিঙ্গ ঢুকছে, তাদের একটি বড় অংশ রাখাইনের মংডু শহরের সচ্ছল পরিবারের লোকজন।