২০২৩ সালের জুনে অফিস সহায়ক পদে জনবল নিয়োগে জেলাভিত্তিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক। প্রতি জেলায় কতজন জনবল নিয়োগ হবে তার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। নির্দেশনা ছিলো, সে সংখ্যা অনুযায়ী নিয়োগ সম্পন্ন করা হবে। তবে নিয়মকে তোয়াক্কা না করে অনিয়মের বেড়াজালে নিয়োগ সম্পন্ন করেন সম্প্রতি ব্যাংকের অপসারণ সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মো. জামিনুর রহমান। তবে এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত ব্যাংকের সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট শাহেদ আলমগীর ও সিস্টেম এনালিস্ট আল্লামা মোহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া তানহার।
অভিযোগ ছিল- বিভিন্ন অংকের টাকার বিনিময়ে নিয়োগ বাণিজ্য করতেন শেখ মো. জামিনুর রহমান। মোটা অংকের অর্থ পেলেই বিভিন্ন জেলায় সংখ্যার চেয়ে বেশি নিয়োগ দিতেন তিনি। তার দায়িত্ব থাকাকালে নিয়োগের কয়েকটি কাগজ এসেছে দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসের হাতে। যেখানে জেলায় নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে বেশি নিয়োগের বিষয়টির সত্যতা মিলেছে।
কাগজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগে নিয়োগে নিয়মবহির্ভূত কাজ করা হয়। যেখানে মুন্সীগঞ্জে ৩ জন জনবল নিয়োগের কথা ছিল। কিন্তু সেখানে ৪ জন নিয়োগ করা হয়। এছাড়াও ফরিদপুরে ৪ জনের বিপরীতে ৬ জন, গোপালগঞ্জ ১ জনের বিপরীতে ১০ জন, রাজবাড়ী ৩ জনের বিপরীতে ৮ জন, কিশোরগঞ্জে ৮ জনের বিপরীতে ১০ জন, টাঙ্গাইলে ৯ জনের বিপরীতে ১৩ জন, ময়মনসিংহে ১৫ জনের বিপরীতে ১৮ জন, নেত্রকোণায় ১ জনের বিপরীতে ৯ জন, শেরপুরে ২ জনের বিপরীতে ৭ জন, ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় ৬ জনের বিপরীতে ৭ জন, কুমিল্লা ১ জনের বিপরীতে ১১ জন, ফেনী ১ জনের বিপরীতে ১১ জন, জয়পুরহাট ১ জনের বিপরীতে ৩ জন, সিরাজগঞ্জ ৪ জনের বিপরীতে ৮ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ২ জনের বিপরীতে ৭ জন, বগুড়া ৬ জনের বিপরীতে ১১ জন, রংপুর ৪ জনের বিপরীতে ৭ জন, দিনাজপুর ৭ জনের বিপরীতে ৯ জন, কুড়িগ্রাম ৭ জনের বিপরীতে ৯ জন, নীলফামারী ৩ জনের বিরপীতে ৬ জন, পঞ্চগর ১ জন নিয়োগ করার কথা থাকলেও সেখানে নিয়োগ করা হয় ২ জন। ঠাকুরগাঁও ২ জনের বিপরীতে ৫ জন, ঝিনাইদহ ৩ জনের বিপরীতে ৪ জন, মাগুরা সংখ্যায় মাইন্যাস থাকলেও সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয় ৩ জন।
এছাড়াও নড়াইলে ১ জনের বিপরীতে নিয়োগ করা হয় ৩ জন, বাগেরহাট প্রায় ৩ জনের বিপরীতে ৪ জন, কুষ্টিয়া ৬ জনের বিপরীতে ৮ জন, মেহেরপুর ১ জনের বিপরীতে ২ জন, বরিশাল ৩ জনের বিপরীতে ৭ জন, ভোলা ৩ জনের বিপরীতে ৭ জন, পিরোজপুর ২ জনের বিপরীতে ৪ জন, বরগুনা ২ জনের বিপরীতে ৩ জন এবং হবিগঞ্জ ৬ জনের বিপরীতে ১০ জন নিয়োগ দেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, জেলা চিহ্নিত করে অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা বহু শিক্ষার্থীকে ফেল করানো হয়েছে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও ডাকা হয়নি ভাইভায়। শেখ মো. জামিনুর রহমান নিজে ফোন করে এসব পরীক্ষার্থীকে ফেল করার ব্যবস্থা করে দেন। এছাড়াও পরীক্ষার উত্তরপত্রে কম নাম্বার পাওয়া অনেক পরীক্ষার্থীকে অর্থের বিনিময়ে চাকরি ব্যবস্থা দিয়েছেন তিনি। যেসব টাকা সবই নিজের পকেটে ভরেছেন। এসব বিষয় নিয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হলেও কোনো কিছুই আমলে নেননি সে সময় দায়িত্বরত ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আকরাম-আল-হোসেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, ‘এতদিন ব্যাংককে লুটেপুটে খেয়েছেন শেখ মো. জামিনুর রহমান। বিভিন্ন অনিয়ম করে নিজের পকেট ভারী করেছেন তিনি। নিয়মের কোনো তোয়াক্কা না করে অনিয়ম করেছেন তিনি। প্রকাশ্যে তিনি এসব অপকর্ম করলেও কথা বলেনি কেউ।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিয়োগ বাণিজ্যে অনেক টাকা কামিয়েছেন তিনি। অতিরিক্ত টাকার লোভ সামলাতে না পেরে বহু পরীক্ষার্থীকে তিনি ফেল করে দিয়েছেন। যেখানে ৫ জন নিয়োগ হওয়ার কথা ছিল, সেখানে ৩ জন নিয়েছেন তিনি। এই ২ জন অন্য জেলা থেকে যারা টাকা বেশি দিয়েছে তাদের নিয়োগ দিয়েছে। আওয়ামী লীগকে খুশি করতে গোপালগঞ্জে বেশি অনিয়ম করে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি।’
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে নানা অনিয়মে পাঁচ সদস্যদের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যার প্রধান হিসেবে রয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন। তদন্তকাজ এখনও চলমান। একইসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তবে এখনও দুর্নীতির তদন্ত অনুসন্ধান শুরু করেনি দুদক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাংকের নানা অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে একটি অভিযোগপত্র দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। অভিযোগপত্রটি জমা দেন দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকতা আবুল কালাম আজাদের কাছে।