কথায় কথায় শিক্ষকদের শোকজ, কোনো কারণ ছাড়াই এসিআর এ বিরূপ মন্তব্য, শিক্ষকদের বদলি করার জন্য বিভিন্ন আওয়ামী দিবসে অবমাননার অভিযোগ, বিএনপি-জামাত বলে প্রকাশ্যেই তালিকা দিতেন মন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ে। এভাবেই শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানি করতেন শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. ইদ্রিস আলী। যার কিছু কাগজ এসেছে দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসের হাতে। মো. ইদ্রিস আলী ১৪তম বিসিএস কর্মকর্তা।
তথ্য বলছে, কলেজের সম্পদ কাজল কোঠা বিল লিজ থাকা অবস্থায় তা বাতিল করেন অধ্যক্ষ মো. ইদ্রিস আলী। সেটি উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মাহবুবুল ইসলাম মনিরের হাতে তুলে দেন তিনি। মনির উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল হোসেন সরকারের মেয়ের জামাই। পৌরসভার মেয়র বিল্লাল হোসেন সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে পৌরসভার ময়লা ফেলে কলেজের সম্পত্তি কাজল কোটা বিলের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করার অনুমতি দেন মো. ইদ্রিস আলী।
এখানেই থেমে থাকেনি মো. ইদ্রিস আলীর দুর্নীতির নানা পন্থা। প্রায় সময়ই বিভিন্ন প্রকাশনার নাম করে রিসিটবিহীন টাকা আদায় করতেন অধ্যক্ষ। যার পরিমাণ প্রায় কোটি টাকার উপরে। কলেজে ছাত্রদের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা নেই। তবুও পরিবহনের নামে প্রতি বছর আদায় করা হতো প্রায় দেড়কোটি টাকা। এছাড়াও ব্যাংকে জমার অতিরিক্ত টাকা কলেজের লাইব্রেরিয়ান আলী হায়দার এবং বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শাহ মাহফুজুল বারীর নেতৃত্বে ভাগাভাগি হতো সন্ধ্যার পর। সব অনিয়মের বিভিন্ন ভুয়া বিল-ভাউচার আলী হায়দার সাহেব গোপনে জমা রাখতেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। অধ্যক্ষের এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন মিঠুন দাস নামের এক কর্মচারী। কিন্তু প্রতিবাদ করায় তাকে দীর্ঘক্ষণ দুর্গদ্ধযুক্ত টয়লেটে আটকে রাখেন তিনি। পরবর্তীতে শাস্তি হিসেবে মিঠুন দাসকে বদলি করা হয় ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায়।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হয় অধ্যক্ষ মো. ইদ্রিস আলীর সাথে। একাধিকবার তার মুঠোফোনে ফোন দিলে রিসিভ করেননি তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার স্বনামধন্য হিসেবে পরিচিত ছিল শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজ। শহরের খুব কাছে এই কলেজ হওয়ায় ভর্তি নিয়ে এক সময় প্রতিযোগিতা চলতো শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তবে এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে। আওয়ামী সরকারের আমলে ক্ষমতার দাম্ভিকতা, অনিয়ম আর দুর্নীতিতে জর্জরিত এই কলেজ একচ্ছত্র আধিপত্যে প্রায় মৃত্যুশয্যায়। এছাড়াও কলেজ থেকে অধ্যক্ষের জন্য গাড়িচালক নিয়োগ করা হয়। তবে সেই চালক কলেজের নিয়ম অনুযায়ী কাজ না করে কাজ করেন অধ্যক্ষের ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসেবে। এছাড়াও আমিনুল ইসলাম কলেজের পিয়ন হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও কাজ করেন অধ্যক্ষের বাসায়।
অভিযোগ রয়েছে, সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বাবুর ছোট ভাই হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন অধ্যক্ষ মো. ইদ্রিস আলম। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদের ব্যবহার করে কলেজের প্রভাব বিস্তারে একতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মেতে উঠেন তিনি। এমনকি প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. পাপিয়া সুলতানার কাছে ডিগ্রি ইনকোর্স পরীক্ষা কমিটি থেকে টাকা দাবি করেন তিনি। তবে পাপিয়া সুলতানা টাকা দিতে রাজি না হলে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বিকল্প কমিটি করে টাকা উত্তোলন করেন অধ্যক্ষ। পরবর্তীতে সে টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করেন তারা।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. পাপিয়া সুলতানা দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, ‘তিনি বললেন কমিটির ৭০ শতাংশ টাকা রেখে দিবেন। বাকি ৩০ শতাংশ টাকা বাকিদের মধ্যে ভাগাভাগি করবেন। আমি এ প্রস্তাবে রাজি না হই না। পরে ওনারা বিরক্ত করছিলো। পরে আমি তাদেরকে বলেছি যে, আপনাদের কমিটি আপনারা নিয়ে নিবেন না কি করবেন আপনাদের বিষয়। আমি আর এসবের মধ্যে নেই।’
তথ্য বলছে, মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগে তিন শিক্ষককে কলেজ থেকে বদলি করেন অধ্যক্ষ মো. ইদ্রিস আলম। কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আব্দুল মান্নানকে একদিন রুমে ডেকে মানসিকভাবে টর্চার করেন তিনি। মানসিকভাবে টর্চারের এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। পরবর্তীতে তাকে ভোলা সরকারি কলেজে বদলি করা হয়।
এছাড়াও গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শফিকুল ইসলামকে ফেনীর পরশুরাম সরকারি কলেজে বদলি করা হয়। একইসঙ্গে অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক মর্জিনা আক্তারকে বদলি করা হয় শেরপুরের শ্রবরদী সরকারি কলেজে। প্রতিদিন রাত ৮টা পর্যন্ত মর্জিনা আক্তারকে বিভিন্ন কমিটির কাজের বাহানা দিয়ে কলেজে আটকে রাখতেন অধ্যক্ষ। মর্জিনা আক্তার এর প্রতিবাদ করায় তাদের বদলি করা হয় বলে অভিযোগ করেন কয়েকজন শিক্ষক।
ভুক্তভোগী অধ্যাপক আব্দুল মান্নান দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, ‘মন্ত্রীর সাথে সম্পর্ক হওয়ায় অধ্যক্ষের প্রভাব বেশি ছিল। আমি বিভিন্ন সময় অধ্যক্ষকে ডেকে নিয়ে বুঝিয়েছি। তাকে বলেছি এরআগে অধ্যক্ষ যারা এসেছিলেন তারা সবার সাথে আলোচনা করে কাজ করেছেন। তবে এই অধ্যক্ষ কোনোভাবেই শিক্ষকদের পাত্তা দিতেন না।’
অধ্যাপক আব্দুল মান্নান আরও বলেন, ‘দুঃখের কথা হলো আলী হায়দার লাইব্রেরিয়ান হয়ে প্রশাসনে খবরদারি বেশি করতেন। শুধু টাকা পয়সার হিসেব নিতেন। টাকার হিসেব ছাড়া কিছুই বুঝতেন না তিনি। তাদের ওপেন সিন্ডিকেট ছিল। যা সম্পর্ক সবাই অবগত। আমি এ বিষয়ে আর বেশি কিছু বলতে চাই না।’
সূত্র বলছে, অধ্যক্ষের সব অনিয়ম ও দুর্নীতি মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিত কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শাহ মাহফুজুল বারী। অধ্যক্ষকে অনিয়মের কাজে সহায়তা করেন হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এএসএম খবির হোসেন, রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানভীর আহমেদ ও ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. নাসির উদ্দিন এবং লাইব্রেরিয়ান আলী হায়দার। তাদের নিয়েই একচ্ছত্র একতন্ত্র কায়েম করেন অধ্যক্ষ। ফলে অধ্যক্ষের অত্যাচারের ভয়ে অতিষ্ঠ হয়ে বদলি হয়ে অন্য কলেজে চলে যান চারজন শিক্ষক। তারা হলেন- রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. লালন মিয়া, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক মো. সাইফুল ইসলাম, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ মাহবুবুল ইসলাম সুমন এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. পাপিয়া সুলতানা।
কয়েকজন শিক্ষক জানান, কলেজে এমনিতেই শিক্ষক সংকট। তারপর আবার শিক্ষকরা বদলি হওয়ার কারণে কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। দুই বছর ধরে কলেজে সাতটি পদ ফাঁকা পড়ে আছে। যা কলেজের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
তারা আরও জানান, কিভাবে প্রতি বছর দুর্নীতির খাত তৈরি করতে হবে, অতিরিক্ত ফি আদায় করে লাখ লাখ টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করা যাবে, প্রতিবাদ করলেই কোন টিচারকে হয়রানি এবং বদলি করতে হবে, কোন কোন কর্মচারীর বেতন মাসের পর মাস আটকে রাখতে হবে এবং তাদের বেতন কেটে রাখতে হবে, কোন কর্মচারী অধ্যক্ষের বাসায় গিয়ে কাজ করতে রাজী না হলে তার শাস্তি হিসেবে কেমন ডিউটি দিতে হবে তা নির্ধারণ ছিল এই সিন্ডিকেটের অন্যতম কাজ।