#অধিকাংশ শাখায় গ্রাহকদের ভোগান্তি
#২৫ হাজার টাকা তুলতে সময় লাগে তিনদিন
#‘ব্যাংক থেকে ১০-১৫ হাজার টাকার বেশি দেয় না’
#‘গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা ছাড়া বিকল্প নেই’
মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। বর্তমানে ওমান প্রবাসী। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ২০১৭ এবং ২০২০ সালে ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে দুটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ভালোভাবেই চলে তার ব্যাংকিং কার্যক্রম। কিন্তু, চলতি বছরের আগস্ট মাসে এসে পড়েন চরম বিপাকে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুল্থানে সরকার পতনের পর ব্যাংকে তারল্য সংকট এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে, ১০ হাজার টাকা তুলতে তার পরিবারকে ৩ ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। এমনকি ২০ হাজার টাকার ওপরের চেক গ্রহণ করেন না ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বড় দারোগাহাট শাখায় ব্যবসায়ীক কার্যক্রম পরিচালনা করেন মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। ওমানে বসে ডলার পাঠান আর দেশে থেকে চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করেন তার পরিবার। ব্যাংকে মোটা অংকের টাকা আছে প্রবাসী মোহাম্মদ আবদুল্লাহর। তবে চাহিদা অনুযায়ী টাকা তুলতে পারছেন না। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে তারা। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকে থাকা আমানত নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন আবদুল্লাহ।
ওমান থেকে মোবাইল ফোনে মোহাম্মদ আবদুল্লাহ দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, ‘আমার দুই অ্যাকাউন্টে সমস্যা। প্রতিদিন পাঁচ হাজার টাকা ট্রান্সফার করা যায়। ছয় দিনে ত্রিশ হাজার টাকা স্বজনদের মোবাইলে ট্রান্সফার করে এরপর বের করতে হয়। খুবই যন্ত্রণায় আছি। ব্যাংকে চেক নিয়ে গেলে ১০-১৫ হাজার টাকা পরিবারের হাতে ধরিয়ে দেয়।’
মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আরও বলেন, ‘আমার দুই অ্যাকাউন্ট দুই শাখায়। দুটোই একই শাখার অধীনে। শুধু দুই শাখা দুই জায়গায় খুলেছে। গত রোববার অন্য শাখায় ১০ হাজার টাকার জন্য ব্যাংকে লোক পাঠিয়েছিলাম। প্রথমে তারা টাকা দিতে পারিনি। পরে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যাংকে বসিয়ে রেখে ১০ হাজার টাকা দেয়। খুবই সমস্যায় আছি। ব্যাংক থেকে ১০-১৫ হাজার টাকার বেশি দেয় না।’
ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমন চিত্র শুধু চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বড় দারোগাহাট শাখার নয়। সারা দেশের সব শাখাতেই কমবেশি এমন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন গ্রাহকরা। পর্যাপ্ত তারল্য না থাকায় গ্রাহকদের চাহিদা মোতাবেক অর্থ দিতে পারছেন না কর্তৃপক্ষ। ফলে এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যাংকে রেখে দুশ্চিন্তা আর অর্থ হারানোর শঙ্কায় দিন পার করছেন গ্রাহকরা।
আরিফুল ইসলাম নামের এক গ্রাহক দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, ‘ব্যাংকে আমার একটা এফডিআর আছে। ভবিষৎতের জন্য টাকাটা সঞ্চয় রেখেছি। সন্তানরা বড় হলে তখন টাকাটা উঠাবো বলে ইচ্ছে ছিল। তবে ব্যাংকের যে অবস্থা দেখছি, তাতে দিনরাত ভয় কাজ করে। আদৌ টাকাটা ঝামেলামুক্ত পাবো কি-না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।’
আরিফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ব্র্যাঞ্চের ম্যানেজারের সাথে আমার কথা হয়েছে। তিনি আমাকে আশ^স্ত করেছেন। কিন্তু ব্যাংকে তারল্য সংকট থাকলে ম্যানেজার তো পকেট থেকে টাকা দিবে না। যেখানে ব্যাংকেই টাকা নেই, সেখানে গ্রাহকরা তাদের জমানো অর্থ কিভাবে ফিরে পাবে।’
তথ্য বলছে, গত ১৬ বছর ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংককে দুর্বল করেছেন আওয়ামী কিছু চিহ্নিত ব্যবসায়ী। সেই তালিকায় ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক রয়েছে। এসব ব্যাংক দুর্বল করার পিছনে যেসব আওয়ামী ব্যবসায়ীর হাত রয়েছে তারমধ্যে এসআলম ও সালমান এফ রহমান অন্যতম। এসব ব্যবসায়ীরা নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে ঋণ নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। যার সবই এখন খেলাপি ঋণ। ব্যবসায়ীক দোহায় দেখিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন কয়েক হাজার কোটি টাকা। গড়েছেন বিপুল সম্পদ। খেলাপি ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণ খেলাপিদের কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়। তবে চিঠির বিপরীতে কোনো সুফল মেলেনি। বরং পরবর্তীতে ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঋণ নিতে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন ব্যবসায়ীরা। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে নিজেদের লোক বসিয়ে দিয়ে অর্থ নয়ছয় করা হয়। যার সঠিক হিসেব খোদ কোনো ব্যাংক কর্তৃপক্ষেও কাছেও নেই।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ পাহাড়ের চূড়ায়। সুশাসনের অভাবও দীর্ঘদিনের। প্রতিনিয়তই দুর্বল হয়ে পড়ছে কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। তারল্য সংকটসহ ব্যাংকগুলোতে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং নতুন সরকারকে নীতিমালা তৈরি করে দ্রুত তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক অর্থ সহায়তা চেয়েছে। আমি মনে করি, এই অর্থ পেলে ব্যাংকের সমসমায়িক সমস্যা দূর হবে, তবে দীর্ঘমেয়াদি নয়। দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সমাধানের জন্য তারল্য প্রয়োজন। যা অন্য ব্যাংক থেকে নিতে হবে। যেসব ব্যাংকে তারল্য রয়েছে সেসব ব্যাংক থেকে তারল্য নিয়ে ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মতো দুর্বল ব্যাংকে দিতে হবে।’
ড. মো. আইনুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে তারল্য সংকট। আমার এক পরিচিত মানুষ ব্যাংকে গেছে পরশুদিন। শুধু পাঁচ টাকা তুলতে পেরেছেন। তিনি ২৫ হাজার টাকা তুলেছেন তিন দিনে। অবস্থা যদি এমন হয় তাহলে চলবে কিভাবে? গ্রাহকরা ব্যাংকে গিয়ে টাকা পাচ্ছেন না। গ্রাহকদের আমানত দিয়েই ব্যাংকের অবস্থান তৈরি হয়। সেখানে গ্রাহকদের আমানত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সহায়তা দিতে হবে। তবে নতুন করে টাকা ছাপানো যাবে না।’
গত ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে পরিচালিত বেসরকারি খাতের ৯টি ব্যাংকের চলতি হিসেব প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ব্যাংকগুলোতে এই ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৬৭ টাকা। এসব ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। সংকটে পড়া এসব ব্যাংক পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা চেয়েছে। এরমধ্যে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক সহায়তা চেয়েছে ৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এরইমধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকসহ পাঁচ দুর্বল হাজার কোটি টাকার বেশি সহায়তা পেয়েছে।
সূত্র বলছে, তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে (এফএসআইবি) ১০০ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দেবে বেসরকারি খাতের দ্য সিটি ব্যাংক। এরইমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে এ তারল্য সহায়তার গ্যারান্টি দেওয়ার জন্য একটি আবেদন করেছে এফএসআইবি। সেখানে সিটি ব্যাংকের কাছে থেকে তারল্য সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
তারল্য সহায়তা নিয়ে চলমান সমস্যা থেকে কতটুকু উত্তোরণ মিলবে এবং গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে আগামীতে কি ধরনের পদেক্ষপ গ্রহণ করবেন কর্তৃপক্ষ? তা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হয় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক(এমডি) সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলীর সঙ্গে। তবে তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি।