আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন খানিকটা বিলম্বিত হচ্ছে বিবেচনায় রেখেই সারাদেশে সাংগঠনকি কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। তাই এই মুহূর্তে নির্বাচনি পরিবেশ না থাকলেও অনেকটাই কৌশলে (রাজনৈতিক) ধানের শীষের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। সারাদেশের বিভিন্নস্থানে কর্মীদের চাঙা রাখতে সাংগঠনিক সফরে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
এরই ধারাবাহিকতায় স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল এবং সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের শীর্ষ নেতারা সমন্বয় করে কর্মীদের চাঙা রাখতে সাংগঠনিক সফরে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন। এছাড়াও গত জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার সরকারবিরোধী আন্দোলন ঘিরে যে সকল এলাকায় দলের নেতাকর্মীরা নিহত-আহত হয়েছেন তাদের স্মরণে সমাবেশ করা হচ্ছে। ভার্চুয়ালি প্রতিটি সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্যে রাখছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দিচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা।
‘আমরা যদি থাকি সৎ-দেশ সংস্কার সম্ভব’ স্লোগান নিয়ে কর্মীসভা করেছেন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতারা। উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকা, সংগঠনকে শক্তিশালী করা, সাংগঠনিক কাঠামো যাচাই-বাছাই করা এবং দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কঠোর বার্তা তৃণমূলে পৌঁছে দেয়া। পাশাপাশি তৃণমূলের নেতাকর্মী এবং বিএনপির কাছে সাধারণ জনগণের আগামী দিনের প্রত্যাশা কী, এ বিষয়েও জনগণের মতামত নেয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জেলায় যৌথ কর্মীসভা ও লিফলেট বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে ৩ সংগঠন। তবে এবারের লিফলেটে শুধু ধানের শীষ প্রতীক ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি লেখা ছাড়া কোনো লেখা কিংবা কোনো নেতার ছবি রাখা হয়নি।
৩ সংগঠনের সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, ধানের শীষ লিফলেট বিতরণ করার উদ্দেশ্য মূলত দলকে তৃণমূল পর্যায়ে জনসম্পৃক্ত করা। দেশ ও দেশের জনগণকে নিয়ে বিএনপির আগামীর চিন্তাধারা গণমানুষের মধ্যে শেয়ার করা।
অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ বা আগামী নির্বাচন কবে হবে, এ ব্যাপারে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হলেও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণ শেষে নিউইয়র্কে ভয়েস অব আমেরিকা বাংলাকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি।
সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সরকার কখন মেয়াদ ঠিক করবে সেটা সরকারকে বলতে হবে। সরকার না বলা পর্যন্ত সেটা তো সরকারের মেয়াদ হচ্ছে না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই মাঠে নেমেছে বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও লক্ষ্য আগামী নির্বাচনের দিকে। এটাই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য।
তিনি বলেন, এখন যারা সরকারে আসছেন তারা নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন। জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র পুণঃপ্রতিষ্ঠায় তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জনগণের প্রধান অধিকার হচ্ছে ভোটের অধিকার। আমার এই সরকারকে সমর্থন দিয়েছি, এখনো দিচ্ছি এবং অতি দ্রুত নির্বাচনের দাবি করছি। সেই সঙ্গে আমাদের দল ও অঙ্গ-সংগঠন সাংগঠনিক ও নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। আশা করি, যত দ্রুত সম্ভব এই সরকার নির্বাচন দিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করে বিদায় নেবে।
অবশ্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক প্রাণ ফিরে পেয়েছে বিএনপি। তাই সারাদেশে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছে দলটি। এছাড়াও আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে টার্গেট সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চা। এজন্য দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় জোর দেয়া হচ্ছে। কেননা বর্তমান পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীরা যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়েন সে জন্য মাঠে নেমেছে দলটির তিন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন। হাইকমান্ডের নির্দেশে নেতাকর্মীদের আরও জবাবদিহির আওতায় আনতে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে যৌথ কর্মীসভা শুরু করেছেন সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। একইসঙ্গে দলীয় প্রতীক ধানের শীষের প্রচার-প্রচারণায় নেমেছে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল ও ছাত্রদল। বিএনপির নেতাকর্মীরা সাধারণ মানুষের হাতে হাতে পৌছে দিচ্ছেন ধানের শীষের ব্যতিক্রমী সাদা কালো লিফলেট। ব্যতিক্রমী এই কারণে যে অতীতে সকল লিফলেটে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবি থাকত। কিন্তু এখন যে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে সেখানে ধানের শীষ প্রতিক ছাড়া কারো ছবি রাখা হয়নি। লিফলেটে নিচের অংশে শুধুমাত্র লেখা রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি।
সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রেক্ষাপটে দেশের বিভিন্ন স্থানে লুটপাট ও দখলবাজির অভিযোগ ওঠে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় বিব্রত বিএনপি হাইকমান্ড। এরই প্রেক্ষাপটে বহিষ্কারও হন কয়েকশ নেতাকর্মী। প্রথম থেকেই দুর্নীতি, লুটপাট, দখল ও নির্যাতন-নিপীড়নের বিষয়ে নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বার্তা দেন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও দলীয়শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর অবস্থানও নেন তিনি। আগামী দিনগুলোতে দলীয় নেতাকর্মীদের আরও বেশি সতর্ক রাখা ও জবাবদিহির আওতায় আনতে এখন সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছেন শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। তারই প্রাথমিক অংশ হিসাবে সারা দেশে যৌথ কর্মিসভা শুরু করেছে বিএনপির তিন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। ভবিষৎ বাংলাদেশের রাজনীতি ও জনগণ নিয়ে তারেক রহমানের যে বার্তা তা দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে পৌঁছে দেবেন সংগঠনের নেতারা।
এদিকে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী সরকারের। দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত সরকার প্রধান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্ঠা হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে মনোনিবেশ করেছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্ঠা। বৈঠকে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্ঠাকে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন। দলগুলোর পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের একটি যুক্তিক সময়ের কথাও বলছেন। একই সঙ্গে নির্বাচনি পরিবেশ তৈরির দিকটিও জোর দাবি উঠে এসেছে। তবে যে কোনো পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থনের অঙ্গীকার করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে এই সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান এসব কথা বলেন।
সবশেষ গত সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্ঠার প্রেস সেক্রেটারি মো. শফিকুল আলম জানান, শিগগিরই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে উপদেষ্ঠা পরিষদ।
তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে, ১৬ না ১৮ মাস পরে, এটা ঠিক করবেন দেশের জনগণ। কমিশনের রিপোর্ট, কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে পলিটিক্যাল কনসালটেশন এবং এই কনসালটেশনের পরে বাংলাদেশের জনগণ বাংলাদেশের সোসাইটি, বাংলাদেশের সমস্ত স্টেকহোল্ডার যখন ডিসাইড করবেন, আমরা এ বিষয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছেছি- তখন নির্বাচনের একটি সমাধান হবে। এটা কবে হবে তা এখনই নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। আর আমার মনে হয়, সেনাপ্রধান এখানে মতামত দিয়েছিলেন। আলোচনাটা খুব দ্রুত হবে এটুকু আমি বলতে পারি, আলোচনাটা হওয়ার পরেই দেখবেন কমিশনের কাজ শুরু হচ্ছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু সাউথ এশিয়ান টাইমস বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আগামী নির্বাচন খুবই গুরুত্বর্পূণ। নির্বাচনের দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট না থাকলেও বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোও দ্রুত সময়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়; বিএনপিও চায়। এজন্য সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতি রয়েছে বিএনপির। ধানের শীষের লিফলেট বিতরণ এটা একটা নির্বাচনি প্রস্তুতির সংকেত।
এদিকে আওযামী লীগের টানা শাসনামলেও বিএনপির ঐক্যবদ্ধ থাকার বিষয়কে দলটির বড় শক্তি বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী।
তিনি উল্লেখ করেন, লম্বা সময়ে চরম বিপর্যস্ত বিএনপিতে যে ভাঙন হয়নি, সেকারণেই দলটির মাঠের নেতাকর্মীরা এখনো মাঠে সক্রিয় হচ্ছে। শুধু বিএনপি নয়; দেশের মানুষ একটা সুষ্ঠু এবং ইনক্লুসিভ নির্বাচনের জন্য ব্যস্ত হয়ে আছে।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সাউথ এশিয়ান টাইমস কে বলেছেন, বিগত ১৭ বছরে এ দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। তরুণ প্রজন্ম ভোটার হয়েও ভোট বিমুখ। অনেকেই ব্যালট পেপার কিংবা ব্যালটে ‘ধানের শীর্ষ’ প্রতীক দেখেননি। এখন বিএনপির টার্গেট তরুণ ভোটারদের উজ্জীবিত করে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের মধ্যে সুস্থ ধারার রাজনীতির চর্চা করা। গতানুগতিক রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনেও জোর দিচ্ছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এজন্য সারা দেশে নতুনভাবে সংগঠনিক শক্তি সঞ্চয়ে বিভিন্ন উপায়ে মাঠে নেমেছেন দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতারা। এছাড়াও রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে নির্বাচনের বিকল্প দেখছেন না তারা। সবশেষ ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকার বিদায় নিয়েছে। কিন্তু তাদের সাজানো প্রশাসন এখনো বহাল রয়েছে; যদিও কোথাও কোথাও পরিবর্তন হচ্ছে। তবে সেই পরিবর্তনের সংখ্যাটা সীমিত। কাজেই দীর্ঘদিনের সাজানো প্রশাসনকে স্বপদে বহাল রেখে আর যাই হোক নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি হবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র, মানুষের মৌলিক অধিকার ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন সংগ্রাম ক রে আসছে। এখনো আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত আছে। কেননা অন্তর্বর্তী সরকার আর অন্য কোনো সরকারের কথা বলেন না কেন; জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় না আসা পর্যন্ত মানুষের অধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাছাড়া বিএনপি এমন একটি রাজনৈতিক দল যেখানে নির্বাচনের জন্য আলাদা করে প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে না।