• ধর্ষণের শিকার ৪৪ জন
• নির্যাতনের শিকার ১১০ নারী ও শিশু
• নির্যাতন ও হয়রানির শিকার ৯০ সাংবাদিক
• ‘জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে’
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় সরকার পতনের আন্দোলন দমনে পুলিশের দমন-পীড়নে শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক ব্যক্তি, সাধারণ মানুষসহ নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে হাজারের ওপরে। এছাড়াও আহতের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। ক্ষমতার মসনদ আঁখড়ে ধরতে গণআন্দোলনে মানবাধিকার লঙ্ঘন করার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে আওয়ামী সরকার। যা এখনও নীরবে করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। গণআন্দোলনে সরকার পতন হলেও এখন প্রতিনিয়িত আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক সহিংসতা, গণপিটুনিতে হত্যা, রাজনৈতিক মামলা ও গ্রেফতার, সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ, শ্রমিক হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, কারা হেফাজতে মৃত্যু, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা, সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশি নির্যাতন ও হত্যা, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। সদ্য বিদায়ী সেপ্টেম্বর মাসে ৩৬টি গণপিটুনি ঘটনায় ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা বিগত সময়ের চেয়ে বেড়েছে।
বৃহস্পতিবার (০৩ অক্টোবর) সাউথ এশিয়ান টাইমসের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে ‘হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি’। সেখানে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং সংগঠনটির সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে সেপ্টেম্বর মাসের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সদ্য বিদায়ী সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে ৩৬টি গণপিটুনির ঘটনায় ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও আহত হয়েছেন আরও ১৪ জন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের সামনে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে। এরইমধ্যে তার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়াও এ মাসে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে বাঙালি-পাহাড়িদের সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সংগঠনটি বলছে, সেপ্টেম্বরে ৮৩টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৭০৬ জন। সহিংসতার ৮৩টি ঘটনার মধ্যে ৪৫টি ঘটনা ঘটেছে বিএনপির অন্তকোন্দলের কারণে, ২৩টি বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে, ৫টি আওয়ামী লীগের অন্তকোন্দল এবং ১০টি ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন দলের মধ্যে। নিহত ১৬ জনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ১ জন, বিএনপির ৮ জন কর্মী। বাকি ৭ জন নিহত হয়েছেন বিরোধী পক্ষের হামলায়। এছাড়াও সারা দেশে আধিপত্য বিস্তার ও দুর্বৃত্তের হামলায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও জামায়াতের আরও ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সকল সহিংসতায় কমপক্ষে ২৫০টি ঘরবাড়ি, যানবাহন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এক মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নেতাকর্মীদের নামে ৯২টি মামলা হয়েছে। এ সকল মামলায় ৬ হাজার ৮ শত ৭৬ জনের নাম উল্লখে করা হয়েছে এবং ১২ হাজার ৫ শত ৬২ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ এবং হেফাজতে ৯ জন নিহত হয়েছেন। খাগড়াছড়িতে জুনান চাকমা এবং রুবেল চাকমা নামের ২ জন পাহাড়ি নিহত হয়েছেন। আশুলিয়ায় পুলিশের গুলিতে কাউসার হোসেন নামের এক পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযানে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের হেফাজতে সৈয়দ নুরুল করিম নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও সারা দেশের কারাগারে অন্তত ৬ জন আসামির মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ৬ জনের মধ্যে ৪ জন কয়েদি ও ২ জন হাজতি। ১৮টি ঘটনায় ৯০ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ২ হামলার ঘটনায় ১টি মন্দির ও ৪টি প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ৯০ জন।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে বাঙালি ও পাহাড়িদেও সংঘর্ষে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও শতাধিক। এ সময় আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়সহ ৩০-৪০টি বাড়িঘর ও দোকানপাটে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ সময় ৩০টি যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক আবুল হাসনাত মুহাম্মদ সোহেল রানাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
৩৪টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ১৭৬ জন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং শ্রমিকদের সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের অভাবে দুর্ঘটনায় ২১ জন শ্রমিক কর্মস্থলে মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা কারখানায় বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৬ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়ও বগুড়ায় কারখানার যন্ত্রাংশ মেরামতের সময় ট্যাংক বিস্ফোরণে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) ৩টি হামলার ঘটনায় ২জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪ জন এবং গ্রেফতার হয়েছেন ২ জন। এরমধ্যে স্বর্ণা দাস নামের এক কিশোরী মৃত্যু ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ঢাকা।
সেপ্টেম্বরে ১১০ জন নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৪ জন। এদের মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু ১৫ জন। ১৮ জন নারী ও কন্যা শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর ৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে, আত্মহত্যা করেছেন ১ জন। ২১ জন নারী ও কন্যা শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ জন। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ২৬ জন, আহত হয়েছেন ১০ জন। আত্মহত্যা করেছেন ৭ নারী। ৭৩ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদেরমধ্যে ৪১ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৩২ জন শিশু শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজ ও বিরোধী দলগুলের সাথে আলোচনার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা জরুরি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আর এ সকল বিষয় বাস্তবায়ন করতে না পারলে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে।’
ইজাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি’র পক্ষ থেকে সরকারকে মানবাধিকার রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি দেশের সকল সচেতন নাগরিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে আরও সোচ্চার হতে হবে।’