এডিস মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪৭ হাজার শনাক্তের পাশাপাশি ২৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে গত সেপ্টেম্বরে ৮০ জনেরই মৃত্যু হয়েছে। যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের বেশিরভাগই ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ভুগছিলেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ধীরে ধীরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও নিয়ন্ত্রণে ‘নীরব’ সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও কোনো প্রতিকার নেই।
কামাল হোসেন নামের একজন বাসিন্দা দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই সিটি করপোরেশন লুকোচুরি খেলা খেলে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু হয় আর এসিতে বসে সংশ্লিষ্টরা নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। যার কোনোটাই বাস্তবে শতভাগ সফলতায় রূপ নেয় না। এ দায় অবশ্যই সরকারের নিতে হবে। কোনোভাবেই এই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘মশা নিধনের নামে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা লোকসান করে সিটি করপোরেশন। অথচ এই টাকাগুলো ভালোভাবে কাজে লাগানো গেলে মানুষ উপকৃত হতো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যেন যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে আরও ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সঙ্গে এই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ১ হাজার ১০০ জন। হাসপাতালে নতুন ভর্তিদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১২১ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৪৮ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৮৪, ঢাকা উত্তর সিটিতে ২৪২, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১৬০, খুলনা বিভাগে ১৪৩ জন রয়েছেন। এছাড়া রাজশাহী বিভাগে ৪০ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩২, রংপুর বিভাগে ২৬ এবং সিলেট বিভাগে চারজন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর থেকে ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলররা অফিস করছেন না, এক কথায় তারা লাপাত্তা। এরমধ্যে ডিএনসিসির সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া বাকিদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের মতাদর্শের। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দুই সিটি কর্পোরেশনের সব কাউন্সিলরকে অপসারণ করা হয়। ফলে ভেঙে পড়ে মশক নিধন কার্যক্রম। এরপর থেকে ডেঙ্গু মোকাবিলার সাধারণ কার্যক্রমগুলোও সেভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। আর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে মেয়রের স্থলে প্রশাসক বসিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। নাগরিকসেবায় তারা কাজ শুরু করলেও অনেক কিছুই এখনো বুঝে উঠছে পারছেন না।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার দুই সিটির ১৮টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট মানদণ্ডের চেয়ে বেশি। সেখানে বলা হয়— দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৮টিতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর হার বেশি। এর অর্থ হচ্ছে এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এলাকাগুলো ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছর এডিস মশাবাহিত রোগের প্রকোপ কমবেশি দেখা যায়। আগে থেকে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, এমন বক্তব্য সংশ্লিষ্টদের মুখে শোভা পেলেও প্রকোপ বাড়লে দায়সারা কাজে দিনশেষে দায়িত্ব শেষ করেন তারা। বরং নিয়ন্ত্রণে উন্নতির চেয়ে অবনতিই বেশি দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু সংক্রমণ কম বা বেশি হওয়া নির্ভর করে, ডেঙ্গু প্রবণ এলাকার জনসাধারণের জ্ঞান, মনোভাব এবং এডিস মশার প্রজনন রোধে তাদের কার্যক্রম ও ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সঠিক ও সময়োপযোগী কার্যক্রমের ওপর। আগামী দিনগুলোয় ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে। তাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম আরও বেগবান করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও প্রস্তুত থাকতে হবে অধিক ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনার।
জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রায় প্রতি বছরই ডেঙ্গুতে মৃত্যু পর্যালোচনা করার জন্য একটি টিম গঠন করা হয়ে থাকে। ডেঙ্গুর প্রতিটি মৃত্যু পর্যালোচনা করে কীভাবে মৃত্যুর হার কমানো যায় সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই এ পর্যালোচনা করা মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এই মৃত্যু পর্যালোচনার রিপোর্টটি গবেষকদের হাতে বা নীতি নির্ধারণের হাতে কতটা পৌঁছায় তা আমার জানা নেই।’
ড. কবিরুল বাশার আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গুর আঘাতের পর থেকে প্রায় প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়। রোগীর সংখ্যা বিচারে বছর ভেদে কম বেশি হয়। এখন গড়ে প্রতিদিন প্রায় পাঁচশত রোগী ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। মনের মধ্যে কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। মশার কাছে পরাজয় আর কতদিন? এই দায় কার? জনগণ, নগরবাসী, সরকার, সিটি কর্পোরেশন না স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়? একজন গবেষক হিসেবে আমারও কি দায়ী নই?’
এসএটি/জেডএম