আবুল কালাম আজাদ। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাবেক সংসদ সদস্য। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও ২০১৪ সালে প্রথম সংসদ সদস্য হন তিনি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর থেকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি এই প্রভাবশালী নেতাকে। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে খুলে যায় আবুল কালাম আজাদের ভাগ্যের চাকা। পেয়ে যান ‘আলাদিনের চেরাগ’।
এলাকায় স্থানীয় নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছেন আবুল কালাম আজাদ। সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে নিজ নামে এবং পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি। উপজেলায় তার পাঁচ শতাধিক সদস্যের একটি সন্ত্রাসী বাহিনীও গঠন করেছিলেন তিনি। এই বাহিনী দিয়ে চালানো হত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে গোবিন্দগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে নিজের মেয়েকে চাকরি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যে কলেজ এখন সরকারি হয়েছে। এছাড়াও অন্যের জমি দখল, সাধারণ মানুষকে নির্যাতন, হত্যা, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসার অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলেন পুরো গোবিন্দগঞ্জ। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, সংখ্যালঘু, আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত কেউই রক্ষা পায়নি তার হাত থেকে। টাকা কামানোর নেশায় তিনি যা ইচ্ছে তাই করতেন। এতে প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে বাধ্য করা হতো।
শুধু তাই নয়, সাঁওতালদের জমি দখল করে রিসোর্ট করতে যান আবুল কালাম আজাদ। এতে বাধা হয়ে দাঁড়ান তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) অবিদীয় মার্ডি। তাকে খুন করে নিজের পথের কাঁটা সাফ করে এগিয়ে যান কালাম। পরে সক্রিয় হন সাঁওতালরা। গড়ে তোলেন আন্দোলন। সাঁওতাল আন্দোলন দমাতে তিন সাঁওতালকেও হত্যা করা হয়। তারপরও জমি চাই তার। আবুল কালাম আজাদের কাজে সম্মত না হলে অফিসারদের সহকারী কমিশনার (ভূমি) অবিদীয় মার্ডির পরিণতির কথা মনে করিয়ে দেওয়া হতো।
তথ্য বলছে, আবুল কালাম আজাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে তার আত্মীয়স্বজনসহ অনেকেই কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তার নিজের শ্যালক মুকিতুর রহমান রাফিকে নৌকার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে তার নিজস্ব গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল করে মেয়র বানিয়েছেন। এছাড়াও সম্প্রতি উপজেলা নির্বাচনে তার মনোনীত প্রার্থী বুলবুল আলম শাকিল আকন্দকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও বানিয়েছেন।
মাদক ব্যবসা, ট্রাক-দূরপাল্লার বাসসহ বিভিন্ন যানবাহন, ভূমি দখল, হাটবাজার সরকারি অফিস থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০ লাখ টাকা আদায় করতেন। এর মধ্য থেকে তার বাহিনীদের পেছনে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ করতেন। যারা আজাদের অতি আপন হতে পেরে ছিলেন, তাদের ভাগ্য বদলে স্বপ্ন দেখতে হয়নি। তারা বাস্তবেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাদের নামে লিজ হতো সরকারি জমি, হাটবাজার, খেয়াঘাট, উপজেলার প্রকল্পের বরাদ্দ, জলমহালসহ ঠিকাদারি কাজ। উপজেলার অন্য জনপ্রতিনিধি তার অধরাধমূলক কাজে বাধা দিলে জামায়াত-বিএনপি তকমা লাগিয়ে মামলা দিয়ে হয়রানি করতেন ও কোণঠাসা করে রাখতেন। এর সব কিছুর হিসাব নিতেন তার ব্যক্তিগত সহকারী আতিকুর রহমান আতিক। ভারতীয় চোরাচালানের ব্যবসা ঢাকায় বসে নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি শ্রীকৃষ্ণ চাকী।
স্থানীয়রা জানান, কালাম আজাদ এক ত্রাস সৃষ্টিকারীর নাম। যার কাজই হলো দুই হাতে টাকা উপার্জন করার ধান্ধা। টাকা উপার্জন করতে কি নেই কালাম করেননি। অন্য মানুষের জমি দখল, গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে প্রতিষ্ঠান দখল, সাঁওতালদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা, পুকুর লিজে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ সবকিছুই তিনি করেছেন। এমনকি বিএনপি নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে বের হলে গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে কুত্তার মতো মারধর করতেন কালাম। নেতাকর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করার জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিথ্যা মামলা দেওয়া হতো। কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললেই ডেকে নিয়ে নিজস্ব বাহিনী দিয়ে নির্যাতন করা হতো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার এক ঘনিষ্ঠ কর্মী দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, ‘উপজেলায় ক্ষমতার মসনদে বসে ‘আলাদিনের চেরাগ’ ঘষতেন আবুল কালাম আজাদ। ‘আলাদিনের চেরাগ’ ঘষলেই টাকা যেত তার কাছে। তিনি সেই টাকা দু’হাতে নিতেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাগদা ফারামে বাগান বাড়ি তৈরি করেছেন তিনি। যেখানে অবসর সময় কাটাতেন নিজে এবং নেতাকর্মীদের সঙ্গে। এছাড়াও নেতাকর্মীদেরও দিয়ে নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজ করাতেন তিনি।’
সূত্র বলছে, আবুল কালাম আজাদের অবৈধভাবে অর্জন অর্থ-সম্পদের খোঁজে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদক সূত্রে জানা যায়, আবুল কালাম আজাদ গোবিন্দগঞ্জে আনুমানিক ১০০ কোটি টাকার জমি, ছয়তলা বাড়ি, ছয়টি ফ্ল্যাট, বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলায় দুটি বাড়ি, ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি বাড়ি, গাজীপুরে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, ২০টির মতো বাস ও ট্রাক কিনেছেন। তিনি ও তার স্ত্রী মোছা. রুহুল আরা রহিম অবৈধভাবে অর্জিত সম্পত্তি হস্তান্তর করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিদেশে পালিয়ে গেলে অনুসন্ধান কাজ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
একটি সূত্র দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে জানান, আবুল কালাম আজাদ এক সময় জাসদ ও বাসদ ছাত্রলীগ করতেন। ১৯৮৬ সালে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মইনুল হাসান রুবেল হত্যা মামলায় কারাগারে যান তিনি। এছাড়া প্রায় ২২ কোটি টাকার চাল আত্মসাতের ঘটনায় দুদকের তদন্তে তার নাম আসে। ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন স্থানে পঞ্চাশটি বাড়ি আছে তার। গাইবান্ধা থেকে গোবিন্দগঞ্জ স্পেশাল নামে যেসব গাড়ি চলে তার মালিক তিনি। তিনি বাবার জমি ভাগে পাঁচ বিঘা পেলেও বর্তমানে তার জমি হাজার বিঘার উপরে। এছাড়া উপজেলার প্রায় পঞ্চাশ বিঘার মতো সরকারি জলমহাল জবরদখল করে মাছের চাষবাদও করছেন তিনি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয় আবুল কালাম আজাদের সাথে। তবে তিনি আত্মগোপনে থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এসএটি/জেডএম