দ্বীন মোহাম্মাদ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক এশিয়ার ক্যান্টনমেন্টের মানিকদি বাজার ব্যাংক এশিয়ার শাখায় একটি একাউন্ট খোলেন তিনি। শাখাটি মূলত এজেন্ট ব্যাংকিং। শুরু থেকে ভালোভাবেই চলছিল তার ব্যাংকিং লেনদেন। একাউন্টে রেখেছিলেন মোটা অংকের টাকা। যা দিয়ে করছিলেন বাড়ি নির্মাণের কাজ। তবে হঠাৎ করেই একদিন তার চোখ কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম। হঠাৎ একাউন্ট থেকে উধাও টাকা। কথা হল টাকা তিনি না তুললেও কিভাবে ব্যাংক থেকে টাকা লাপাত্তা এটা নিয়ে বেশ চিন্তিত। চিন্তায় অসুস্থ হয়ে যান ষাটোর্ধ্ব দ্বীন মোহাম্মাদ। এবার দ্বারস্থ হন ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে। তোলেন লেনদেনের স্টেটমেন্ট। সেখানেও মেলে অর্থ না থাকার সত্যতা। আর এসব অর্থ চুরির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে শাখার মালিক আতিকুল ইসলাম এবং ক্যাশিয়ার সানজিদা বেগমের বিরুদ্ধে।
ব্যাংক এশিয়া থেকে গ্রাহকের অর্থ চুরির এমন কিছু ভয়ংকর তথ্য এসেছে দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসের হাতে। এর প্রেক্ষিতে অনুসন্ধানে নামেন এ প্রতিবেদক।
অনুসন্ধান বলছে, আতিকুল ইসলাম এবং সানজিদা বেগম স্বামী-স্ত্রী। এজেন্ট শাখা খোলার আগে আতিকুল ইসলাম ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট শাখায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন। কাজের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সহজ-সরল এবং মেধাবী। তবে সেই মেধা তিনি চাকরি জীবনে দেখিয়েছেন। চাকরি জীবন ছেড়ে দেওয়ার পর ২০ লাখ টাকা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে জমা দিয়ে হয়ে উঠেন একটি শাখার মালিক। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে খুলে যায় তার জীবনের অধ্যায়। কাঁচা টাকার গন্ধে হয়ে উঠেন মরিয়া, গড়ে তোলেন আরও পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক এশিয়ার চারটি এজেন্ট শাখা রয়েছে আতিকুল ইসলামের। এছাড়াও একটি স্বপ্ন সুপার শপের অর্থেক মালিকানা রয়েছে তার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আতিকুল ইসলামের এক ঘনিষ্ঠ সূত্র দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে জানান, আতিকুল ইসলাম চাকরি জীবনে সহজ-সরল ছিলেন। কিন্তু এজেন্ট শাখার মালিক হওয়ার পর থেকেই নিজের মুখোশ পাল্টাতে থাকেন। টাকার নেশায় তিনি শাখাগুলোতে নানা অনিয়ম করতে শুরু করেন। গ্রাহকের টাকা নয়ছয় করে হয়ে উঠেন ব্যাংক এশিয়ার মোট চারটি শাখার মালিক। গ্রাহকের ওয়াসায় জমা দেওয়া টাকাও তিনি আত্মসাৎ করেছেন।
সূত্র বলছে, আতিকুল ইসলামের মোট চারটি এজেন্ট শাখা থেকে প্রধান কার্যালয়ে মোট ৭২টা অভিযোগ জমা পড়েছে। সবই অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগসহ অন্যান্য। তবে প্রধান কার্যালয়ে থেকে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাগ্রহণ না করায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন আতিকুল ইসলাম।
অভিযোগ রয়েছে, তথ্য গোপন করে স্টেটমেন্ট বানিয়ে দ্বীন মোহাম্মাদের টাকা হাতিয়ে নেন আতিকুল ইসলাম। যার তিনটি স্টেটমেন্টের কপি দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসের হাতে সংরক্ষণ রয়েছে। যেখানে গ্রাহকের দশ লাখ টাকা গোপন করেছেন তিনি। গোপন করা সেই টাকা ২০২১ সালে ২৯ এপ্রিল ১০৮৩৩২৬০০১৬৮৫ একাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়। যে একাউন্ট খোদ তার স্ত্রী সানজিদা বেগমের। গ্রাহকের অনুমতি না নিয়ে টাকা ট্রান্সফার করা অর্থ আত্মসাতের শামিল। সেই কাজটিই নিজের মনে করে করেছেন আতিকুল ইসলাম। ব্যাংক এশিয়ার প্রধান কার্যালয় থেকে দীন মোহাম্মদের একাউন্টের স্টেটমেন্টের কাগজ তুলে ১০ লাখ টাকা গোপনের সত্যতা পাওয়া যায়। যার কাগজ দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসের কাছে সংরক্ষণ রয়েছে।
শুধু এখানেই থেমে থাকেনি আতিকুল ইসলাম ও সানজিদা বেগম দম্পতির অর্থ আত্মসাতের নানা পন্থা। গ্রাহককে ভুলভাল বুঝিয়ে অতিরিক্ত ট্রান্সজেকশন দেখিয়ে ফায়দাও লুটে নিয়েছেন তারা। তারও একটি স্টেটমেন্টের কাগজ এসেছে দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসের হাতে।
এসব বিষয়ে কথা হয় আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, ‘আপনি যে অভিযোগের বিষয়ে কথা বললেন, এটা গত ৩ বছর ধরে বিভিন্ন মানুষের কাছে থেকে শুনে আসতেছি। দ্বীন মোহাম্মাদরা মিরপুরের স্থানীয় লোক, প্রভাবশালী এবং দৃস্কৃতকারী। দ্বীন মোহাম্মাদরা আমার বাসায় হামলা করেছে, রাস্তাঘাটে হামলা করেছে। একটা লোকের টাকা ব্যাংকে রাখছে ব্যাংক পদ্ধতিগুলো যেভাবে ফলো করার কথা তারা ফলো করেনি। আর মোট কথা আমার হেড অফিস আছে, বাংলাদেশ ব্যাংক আছে, বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা আছে, আদালত আছে। সাড়ে তিন বছর ধরে লেনদেন করে টাকা নিয়ে বলতেছে আমাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা আছে।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে আতিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ আপনি তদন্ত কমিটিকে বলেন যে, তদন্ত কমিটি দ্বারা যে প্রমাণ হয়েছে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকার আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। ৭২টা অভিযোগের বিপরীতে আপনারা ব্যবস্থা নেননি কেন? দ্বীন মোহাম্মাদ টাকা আত্মসাতের বিষয়টি ভুয়া। তারা সন্ত্রাস, দুস্কৃতকারী।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্বীন মোহাম্মাদের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্যাংক এশিয়া। যেখানে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকার সত্যতা পায় তদন্ত কমিটি। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। তবে এখনও এই ঘটনার কোনো অগ্রগতি নেই। দায়িত্ব অবহেলা আর উদাসীনতার মারপ্যাঁচে আটকে আছে ভুক্তভোগীর টাকা।
ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগের কর্মকর্তা রুহুল মতিন দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, ‘আতিকুল ইসলামের বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। ভুক্তভোগী দ্বীন মোহাম্মদকে আমরা কয়েকবার অফিসে ডেকেছিলাম। আতিকুল ইসলাম এবং দ্বীন মোহাম্মদ এদের দুজনকে আমরা একসাথে পাচ্ছি না। গত দুই মাস ধরে তাদের সমস্যা সমাধানে আমরা চেষ্টা করছি।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে রুহুল মতিন আরও বলেন, ‘আতিকুল ইসলামের চারটি শাখা থেকে মোট ৭২টি অভিযোগের বিষয়টি সত্য। আমরা অস্বীকার করবো না। এসব অভিযোগের বিষয়ে অনেক অভিযোগ আতিকুল ইসলাম একাই সমাধান করেছেন। আমরা দ্বীন মোহাম্মাদের বিষয়ে কাজ করছি।’
দ্বীন মোহাম্মাদের ব্যাংক স্টেটমেন্টের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ৩১ মার্চ নিজের একাউন্ট থেকে ২০ হাজার টাকা তোলেন তিনি। একই বছরের ১২ এপ্রিল আবারও ১০ হাজার টাকা তোলা হয়। সে সময় তার ব্যাংকে অবশিষ্ট টাকা থাকে ২১ লাখ ৬৪ হাজার ৯শত ৯২ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু ২৯ এপ্রিল ১০৮৩৩২৬০০১৬৮৫ একাউন্টে ১০ লাখ টাকা ট্রান্সফার করার তথ্য আতিকুল ইসলাম গোপন করে স্টেটমেন্ট দেন দ্বীন মোহাম্মাদকে। অবশিষ্ট ২১ লাখ ৬৪ হাজার ৯শত ৯২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১০ লাখ টাকা গোপন করা হলেও একই তারিখে স্টেটমেন্টে ১১ লাখ ৬৪ হাজার ৯শ ৯২ টাকা ৫০ পয়সা দেখানো হয়েছে।
ভোক্তভোগীর আত্মীয়রা জানান, বাড়ির কাছে এজেন্ট ব্যাংক হওয়ায় আতিকুল ইসলামের সাথে দ্বীন মোহাম্মাদের সম্পর্ক ভালো ছিল। এমনও সময় গেছে লাখ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা হয়েছে কিন্তু তিনি রশিদ নেয়নি। সম্পর্কের খাতিরে ফোনে বলে দিয়েছে যে, আপনার টাকা ব্যাংকে জমা হয়ে গেছে। কিন্তু আতিকুল ইসলাম যে দুর্বলতার সুযোগ এইভাবে নিবেন; কেউ বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ, দ্বীন মোহাম্মাদের সাথে সেইভাবে কেউ যেতেন না। সাথে একটা ছেলে যেত সেও নাকি অন্যরকম। বলতে গেলে সুবিধাবাদী।
দ্বীন মোহাম্মাদের নাতি তাসকিন আহমেদ দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, আমার নানা সহজ-সরল মানুষ। ব্যাংকে লাখ লাখ টাকা তিনি জমা দিতেন বিশ্বাসের ওপর। বয়স বেশি হওয়ায় সবকিছু মনে রাখতে পারতেন না। ভাতিজাকে সঙ্গে করে ব্যাংকে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে আসতো। কিন্তু আতিক এইভাবে টাকাগুলো নয়ছয় করল আমরা দেরিতে জানতে পেরেছি।
তাসকিন আহমেদ আরও বলেন, ঘটনার বিষয়ে তদন্ত হয়েছে। সেই তদন্তে আবার টাকা নয়ছয় করার প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু গত দুই বছর হচ্ছে ব্যাংক এশিয়ার হেড অফিস আতিকুল ইসলামের কাছে থেকে টাকা তুলে নিয়ে দিচ্ছে না। তিনিও টাকা দিচ্ছেন না। আমাদের কথা হলো- ৪২ লাখ টাকা না দিক, তদন্তে যে টাকাটা উঠে এসেছে সেই টাকাটাই আমাদের পরিশোধ করুক। আতিকের কাছে টাকা চাইতে গেলে তিনি ভুলভাল বুঝিয়ে দেয়, সে নাকি টাকা পরিশোধ করে দিয়েছে।
ব্যাংক এশিয়ার তথ্যমতে, এজেন্ট ব্যাংকে টাকা জমার করার সময় গ্রাহককে কোনো রশিদ দিতে হয় না। শুধু টাকা জমা দিলে এজেন্ট পয়েন্ট থেকে গ্রাহককে প্রিন্টেড রশিদ দেন কর্মকর্তারা। তবে দ্বীন মোহাম্মাদের ক্ষেত্রে হয়েছে ভিন্ন। ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট দুটি ডিপোজিট রশিদে ব্যাংকে সাড়ে সাত লাখ টাকা জমা করা হয়। একটিতে আড়াইল লাখ, অন্যটিতে পাঁচ লাখ টাকা। ব্যাংক থেকে জমা করা টাকার রশিদে সিল স্বাক্ষর করা হয়। তবে পরবর্তীতে এই দুই রশিদকে নকল বলে দাবি করেন আতিকুল ইসলাম।
এ বিষয়ে তাসকিন আহমেদ বলেন, যখন টাকার বিষয়ে অস্বীকার যান আতিকুল ইসলাম। তখন অডিট শুরু হয়। অডিটের রিপোর্টেও সত্যতা মিলেছে। এরপর ম্যানেজারের কাছে আমরা টাকা চাইতে গেলে প্রমাণ চান। আমরা যখন রশিদ দেখাই তখন আতিক বলেন এই রশিদ নাকি ভুয়া। যে রশিদে ব্যাংকে সিল ও স্বাক্ষর রয়েছে, সেটা ভুয়া হয় কিভাবে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দ্বীন মোহাম্মাদের একাউন্টে ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা করা হয়। এদিন আলাদাভাবে আরও ২০ লাখ টাকা নিয়ে রেজাউল করিম লিটন নামের এক আত্মীয় নিয়ে আতিকুল ইসলামের কাছে যান দ্বীন মোহাম্মাদ। নগদ ২০ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দেয়া হয়। কিন্তু টাকা জমার বিষয়টি প্রথমে স্বীকার করলেও পরবর্তীতে তা অস্বীকার করেন রেজাউল করিম লিটন এবং আতিকুল ইসলাম। রেজাউল করিম লিটন সম্পর্কে দ্বীন মোহাম্মাদের ভাতিজা। রেজাউল করিম লিটনই এই টাকা আত্মসাতের বিষয়ে সরাসরি জড়িত বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
এসএটি/জেডএম